নপুংসক ( ২য় পর্ব )

ভর দুপুরে তপ্ত রোদে বের হলাম। বর্ষা কালের এমন রোদ মানে হলো ‘ ঝড় আসছে’….। কিছুটা সময় তপ্ত রোদে পুড়িয়ে তুমুল বর্ষন হওয়াই নিয়ম এসময়।

গায়ে সামান্য জ্বর সর্দি আছে বলে রোদের তাপে আরাম নিয়ে হাঁটছি। উদ্দেশ্য কদম্ব ফুল। শাহবাগ থেকে হাত ভর্তি ফুল নিয়ে মতিনের বাসায় উপস্থিত হলাম যখন তখন বিকেল চারটা । মীরা দরজা খুলে হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো। আমি বললাম,

‘কি রে, সরে দাঁড়া। ওরকম আজিব চোখে চেয়ে আছিস্ কেন? যেন ভূত দেখছিস!’

মীরা হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিয়ে বলল,

‘আমার জন্মদিন তোমার মনে থাকবে আমি জানি
শুধু জানিনা তুমি কিভাবে জানলে যে,কদম আমার প্রিয়’

‘যে মেয়ে বর্ষাকালে পৃথিবীতে আসে তার প্রিয় ফুল কদমই হওয়ার কথা। অন্যফুল প্রিয় হওয়া অন্যায়।’

মীরা ওর রুমে চলে গেল। জানি চোখের পানি আড়াল করতে চাইছে সে। যে মেয়ের মা বেঁচে নেই তারা কথায় কথায় ইমোশনাল হয়। মায়ের মমতার ছায়া খোঁজে তারা সবার মাঝে।

দুপুরে খাওয়া হয়নি। খিদে জানান দিচ্ছে। মীরা চা হাতে এসে বললো,’ওঘড়ে একবার যাও,বাবা তোমায় ডাকছে।’ এরমাঝেই মীরা শাড়ি পাল্টেছে। চোখের কাজল খানিকটা লেপ্টে আছে ওর চোখে। তাতেও কি মায়ময়ী লাগছে ওকে। কালির মতো একটা কালো জিনিস যে মেয়েদের রুপ এতটা বাড়িয়ে দিতে পারে, তা কার জানা ছিল! এ বিষয়টা প্রথমে কার মাথায় এসেছিল? বিষয়টা জানা থাকলে ভাল হত।

আমি বললাম, ‘চা এনেছিস্ কেন? স্পেসাল খাবার যা রান্না করেছিস খাওয়া। খেয়েদেয়ে যাই।’

খেতে বসে আর খেতে পারলাম না। খিদে চটে গেছে।অসময়ে খেলে ক্ষিদে চটে যাবারই কথা। খেতে না পারলেও রান্না ভালো হয়েছে। আমি মীরাকে বললাম,

‘তোর রান্নাও তো আমার মা’য়ের রান্নার মতো হয়েছে রে’

‘ হুম, কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি তোমার মায়ের রান্না খেয়েছো?’

‘দীদা বলতো। মা ভাল রাঁধুনী ছিলেন, অনেক লক্ষ্মী ছিলেন। আমাকে বলতো, বড় হয়ে তুই তোর মা’কে নিয়ে আসবি।’

‘আমি বলতাম,’লক্ষ্মী কেমন হয়? সে বলতো- ‘তোর মা এতই লক্ষ্মী ছিলো যে, এক সাবানের শেষের চিলতে সাবানটুকুও নতুন সাবান ভিজিয়ে সেটার সাথে লাগিয়ে রাখতো। নষ্ট করতো না কিছু’

মীরা হঠাৎ বললো,’আমি তোমার মায়ের মতো লক্ষ্মী নই’
আমি আনমনে বললাম,’তার মতো হতে চেষ্টা করিস না। সে নষ্টা ছিল’

মীরা বিস্ময়ের চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে উঠে গেলাম হাত ধুতে।

মীরার বাবা শুয়ে ছিলেন। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি আধোশায় হয়ে বাতি জ্বালালেন। মীরার বাবা নিজাম উদ্দীন আমাকে বিশেষ পছন্দ করেন। কেন করেন তার রহস্য আমি জানিনা। যে ছেলে কর্মহীন, আর যার মা’কে নিয়ে সমাজে নোংরা কথা অপ্রচলিত আছে সে ছেলেকে তার মতো একজন ভালো আইনজীবি কেন পছন্দ করবেন? মীরার মতো মেয়ের জন্য তো এ জগতে ভাল ছেলের অভাব নেই।

নিজাম উদ্দীন হাস্যমুখে বললেন,’তুমি কি করবে বলে ঠিক করেছো?’

বলেই আবার বললেন, এই কাজ কর্ম’

আমি হাসলাম,’কি করবো ভাবছিনা এখনও চাচা’

‘তোমার বাবা কিছু বলছেন না তোমাকে?’

‘বাবা বলেন, তিনি তো বলবেনই’

‘তুমি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ছো। বাজারে ভালো চাহিদা আছে তোমার। মতিকে তো ব্যাংকে ঢুকিয়ে দিলাম। আমার হাতে লোকজন আছে। আমি বললে তোমার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
আমার মীরার বাবার কথায় অস্বস্তি লাগছে। কিছু বলতে পারছি না। উঠেও যেতে পারছি না। কারও কথায় চাকুরী হবে আর তার কাছে নিজেকে ছোট করে রাখতে আমি কোনকালেই পারবোনা। কথা বেশিদূর এগুলো না। কথার পিষ্ঠে কথা না বাড়িয়ে আমি চুপচাপ থাকলাম। একসময় তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। বললেন,

‘খেয়েছ? মীরা নিজ হাতে রান্না করেছে। মেয়েটার হাতে রান্নায় যে কি যাদু, না খেলে বুঝবে না।’

আমি তাকে বললাম না যে খেয়েছি। কারণ বললে তিনি গা ছেড়ে গল্প করবেন। সে সুযোগ তাকে দেয়া যায় না। আমি মিষ্টি একটা হাসি দেবার চেষ্টা করে উঠে আসলাম।

মতিনের বিছানায় শুয়ে আমি আমার জন্মের সময়কার কথা ভাবতে শুরু করলাম। মা তার ডায়েরি শুরু করেছেন আমার জন্মদিয়ে। বিশদ বর্ণনা-

সন্ধ্যায় আকাশ অন্ধকার করে এলো। আমি (মা) তাড়াহুরো করে আঙ্গিনার সব শুকনো কাপড় ঘরে তুললাম। আজ সকাল থেকেই শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ডাক্তারের দেয়া সময় তিনদিন আগেই পেড়িয়ে গেছে। সকালে যখন সে দোকানের মালামাল কিনতে বাহিরে যাচ্ছিলো তখনই তাকে বলেছিলাম না যেতে। সে আমার কথায় গুরুত্ব দিলোনা। গুরুত্ব যে দিবেনা তা আমি জানি। তার অবহেলা আমার প্রতি ছিলো সীমাহীন। কিন্তুু যে আসছে তার প্রতি অবহেলা করা কি ঠিক?

ঘরে ্শ্বাশুড়ি ছিলেন, তিনিও মানা করলেন। তবুও সে চলে গেল। ফিরতে দু’দিন তো লাগবেই।
ঝড় উঠে এলো। বিদ্যুতও চলে গেল। শ্বাশুড়ি অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ ও ঘর থেকে চেচাঁতে লাগলেন, ‘বাতি জ্বালাও বউ’

আমার বাতি জ্বালানোর সাথে সাথেই শুরু হলো প্রসব ব্যাথা। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিলোনা। রাত বাড়ার সাথে সাথে ব্যাথার তীব্রতা বাড়তে লাগলো। আমার আর্তনাদ শুনে শ্বাশুড়ি উঠে এলেন। ছেলেকে ফোন করে পেলেন না। বারবার বলতে লাগলেন,’এখন আমি কি করি একা?’
রাত তিনটার পর আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি হাসপাতালের ডেলিভেরি বেডে । চারদিক সকালের আলো ফুটছে। যে রুমটাতে আমি শুয়ে আছি আমার পাশে কেউ নেই। জ্ঞান ফিরে ব্যাথার প্রখরতা অনুভব করছি এতটাই যে, আমি চিৎকার করে আমার শ্বাশুড়িকে ডাকলাম। আমার চিৎকারে যে ছুটে এলো সে আমার মা……

চলবে……

বেলা প্রধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *