রাত বেশি হয়নি। আমি মায়ের ডায়রি হাতে শুয়েছি। ডায়রির মাঝামাঝি তিনি লিখেছেন-
“তার ব্যবসায়ী বন্ধু আলতাফ চৌধুরী সমন্ধে আমি বারবার সাবধান করেছি বাবলুর বাবাকে । প্রায়ই বিনা কারণে তার আসা যাওয়া নিয়ে তর্ক হত আমাদের দুজনের। বাবলুর বাবা যেন কিছু বুঝতে চাইতো না। ধুরন্দর ঐ লোকটির উদ্দেশ্য আমি ভালভাবেই বুঝতাম। প্রথম যেদিন তার সমন্ধে তাকে বললাম,সে উড়িয়ে দিল আমার কথা।
কাল রাতে আমি তাকে খাবার শেষে পান দিতে গেলাম। পান মুখে দিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল,
‘বাবুকে মায়ের ঘরে দিয়ে আসো’
আমার মনে হলো, এটাই সময়, কথাটা এখন তাকে বলা যায়। বললাম,
‘তোমার চৌধুরী সাহেব রোজ দুপুরবেলা এখানে আসে কেন?’
সে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘আসুক না। সে বিজনেস পার্টনার। আমার বাসায় সে আসতেই পারে। তাতে সমস্যা কি? ‘
আমি তাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম-
‘তুমি বুঝতে পারছ না, লোকটার স্বভাব -চরিত্র ভাল না। আমার তাকে মোটেও ভাল লাগছে না। তার বাসায় আসার দরকার কি? তার বিজনেস তো তোমার সাথে। সে তোমাকে বাহিরেই পায়। বাসায় আসবে কেন?
‘কেন কি হয়েছে?’
‘আজ সে এসে পানি চাইল। আমি তাকে পানি দিতে গেলাম সে আমার হাতটা ধরে ফেলল। জোর করে আমাকে তার কাছে বসাতে চাইল। আমি কষ্টকরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে বললাম, ‘বাবলুর বাবা বাসায় না থাকলে আপনি আসবেন না।’
লোকটা নির্লজ্জের মতো আমার কথা অগ্রাহ্য করে হাসলেন। বললেন,’
তুমি যদি তা তার মুখের উপর বলতে পার তবে সে আসবে না। তুমি কাল তাকে বলে দেবে এখানে না আসতে।’
যে ঘটনা সময় অসময় আমাকে দংশন করছে, সে ঘটনা শুনে বাবলুর বাবার কোন ভাবান্তর হলো না। বরং পানের রস ভরা মুখে হাসতে হাসতে বলল,
‘সে একটু রসিক মানুষ।পুরাই রসিকতা করেছে। তুমি বুঝতে পারনি, ভাবছ অন্য কিছু। ঘাবড়িও না। আমি বলে দেব।’
মনটা খারাপ হয়ে গেল। লোকটা কেন আমার কথা বুঝতে পারছে না। নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছে না। তার কারনটাই বা কি? সে শুধু আমাকে শান্ত করার জন্য কথাটা বললেও আসলে সে বদমাশ লোকটাকে কিছু বলবেনা!
আমার ধারণা ঠিক প্রমান করে পরেরদিন দুপুরবেলা আবার লোকটা এলেন। আমি সোফায় যেখানটায় বসা তিনি উঠে আমার পাশে বসার চেষ্টা করলেন। তেলতেলা হাসি দিতে দিতে নোংরা প্রস্তাব দিলেন আমাকে । প্রস্তাবে সায় দিলে অনেক লাভবান হবার সম্ভাবনা দেখিয়ে চিন্তা করে দেখতে বলে লোকটা বিদায় হলো। রাগে দুঃখে সারাদিন কাদঁলাম। বাবলুর বাবাকে ফোন করে বাসায় আসতে বললাম । সে এলো না। তার নাকি অনেক ব্যস্ততা। পরে এসে শুনবে।
রাতে খাবার টেবিলে আবার তাকে পুরো বিষয়টা বললাম। বাবলুর বাবা আমার কথা বুঝতে চাইলো না আজও। দু’জনায় তর্ক হলো মধ্যরাত পর্যন্ত । সে আমার কথা এড়িয়ে গেল। তার এমন উদাসিনতায় আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। আশেপাশে আমাকে নিয়ে লোকটিকে দিয়ে অনেক গুজব শোনা যেত লাগলো। এসব তার কানেও যাচ্ছিল তবুও স্বামী হিসাবে তার কোন মাথাব্যথা নেই। অবশেষে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে এলাম। শ্বাশুড়ি তার বোনের বাড়ি ছিলেন গ্রামে।
একসপ্তাহ পর সে আবার আমাকে বুঝিয়ে নিয়ে এলো। বুঝালো যে, ব্যবসা বাজারে প্রায় আশি লক্ষ টাকা চৌধুরীর কাছে সে ঋণে জড়িয়েছে। তাকে কিছু বলতে গেলে টাকার চাপ দিতে পারে যা সে এখন পরিশোধ করতে পারবেনা। আমাকে বলল, সে বলে দিয়েছে যে, এরপর লোকটি আর আমাদের বাড়ি আসবে না। আমার মনে হল, বাড়ি না আসলে আর সমস্যা কি? আমি স্বামীর সাথে আবার নিজের বাড়ি চলে আসলাম।
আবার কিছুদিন পর চৌধুরী সাহেব এলেন বাবুর বাবার সাথেই। আমার সাথে ভুল বোঝাবুঝি মিমাংসা করতে। আমার মাথায় কিছুতেই এলোনা যে, এই মানুষটার সাথে এরপরও মিমাংসা কি করে করা যায়? স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে তার অপারগতা অনুভব করে কিছুই বললাম না। কিছুদিন আবারও তার আসা যাওয়া শুরু হলো।
আমি যখনি বাবুর বাবাকে বলতাম,তাকে আমি পছন্দ করছি না, সে আমাকে বুঝাতো,সে তো আর কিছু করছে না।
তারপর একদুপুরে……..
এখানটায় এসে আর পড়তে মন চাইলো না। আমি ডায়েরি বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতে গেলাম। এলোমেলো কত কথা মনটাকে উতলা করছে। বুকে হালকা ব্যথাও করছে। রাতের খাবারে যা খেয়ছি, পেটের মধ্যে তা পাক দেয়া শুরু করছে। বমি করতে পারলে ভাল হতো।
ছটফট করতে করতে ঘুমিয়েছিলাম কি না জানিনা। মাকে দেখতে পেলাম, আমার মাথায় হাত রাখতে। বললেন,
‘বাবলু, তোমার তো জ্বর গায়ে’
আমি তার দিকে তাকালাম,
‘মা, তুমি কি বাবাকে ঘৃণা কর?’
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
‘আমার রাগ ঘৃণা আমার কাছেই থাকুক। তুমি তো তোমার বাবাকে ভালবাস।’
‘আমি বাবাকে ঘৃণা করতে পারিনা মা। তুমি তার কাছে আমাকে পাঠালে, আমি তার গভীর মমতায় মানুষ হয়েছি।’
‘সে তোমার বাবা, আমার স্বামী। একই মানুষ বাবা হিসাবে একরকম, স্বামী হিসাবে আরেকরকম । একটা দিয়ে আরেকটা বিচার করা যায় না বাবা।’
‘তুমি সবকিছু ছেড়ে চলে তো গিয়েছিলে, কেন তুমি সময় থাকতে একেবারে গেলেনা? তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হয়ত ঘটতো না মা’
মা আমার মাথা থেকে হাত সড়িয়ে নিলেন। শান্তস্বরে বললেন,
‘এত সহজে মেয়েরা তার সংসার ছাড়তে পারেনা বাবা। তার শেষ অবধি চেষ্টা করে। তুমি মেয়ে হলে বিষয়টা ভাল বুঝতে।’
মা উঠে চলে গেলেন। আমি তাকে ডাকলাম, মা যেওনা…
তিনি শুনলেন না। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে হঠাৎ। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলাম। জ্বরের ঘোরে একসময় ডুবে গেলাম।
ঝকঝকে সকাল। বাইরের ঘরে মতিনের গলা শুনতে পেয়ে মনটা ভাল হয়ে গেল। ছোটমা রুনু খুব হাসছেন,নিশ্চই মতিন মজাদার কিছু বলছে। কতদিন পর এ বাড়িতে কেউ হাসছে। বাবার অসুখের পর এ বাড়ি থেকে হাসি চলে গিয়েছিল।
কেয়া তানিয়াও আসে প্রায়ই। রুনুর সাথে ওদেরও বেশ জমেছে। ছোটমা সেটা পছন্দ করেন না। কিন্তুু মতিন এলে তিনি অনেক খুশি হন। হয়তো আমি নিজেও হই।
চলবে……
-বেলা প্রধান