নিতুর বিয়ে (১ম পর্ব)

আজ নিতুর বিয়ে। কিছুক্ষন পরই বর আসবে অথচ এখনও সে রান্নাঘরে। মামা এসে তাড়া দিলেন “কি রে তোর হলো? এই তো আর একটু, উত্তর দিল নিতু। মিজান সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজ মেয়েটার বিয়ে, অথচ আজও রান্নাঘরে কাজ করছে। মেয়েটার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এমন হতোনা। নিজের অক্ষমতায় বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো।
হাসান তাকিয়ে আছে নিতুর দিকে। এই মেয়েটার জন্য সে কিছুই করতে পারলো না। কষ্টে বুকটা ভার হয়ে আছে। তার মতো টিউশনি করে চলা লোকদের সংসারে কোনো দাম নেই। না হলে সে কোনো ভাবেই নিতুর চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড়,এক বাচ্চার বাপের সাথে এ বিয়েটা হতে দিতো না। হাসানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিতু বলল, ” ভেতরে আয় ছোট মামা, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ” তুই কেন রাজি হলি বলতো এই বিয়েতে? খানিকটা রাগ নিয়েই কথাটা বললো হাসান। হাসলো নিতু, যার জন্ম মাত্র মা মরে যায়, যার মুখ না দেখেই বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তার এতো পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই মামা। আর মামী যেখানে পছন্দ করে ঠিক করেছেন নিশ্চয়ই খারাপ হবে না।তোর মামীর ভালো খারাপ আমার জানা আছে, না হলে বিয়ের কনেকে দিয়ে কেউ রান্না করায়? আহ ছোট মামা রাগ করছো কেন? কথায় কথায় তোমার এই রাগ করার অভ্যাসটা কমাওতো। আমি চলে গেলে, রাগ করলেও কেউ তোমার রাগ ভাংগাতে আসবে না। চোখের জল লুকাতে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলো হাসান।
আজ রাহেলা খুব খুশী। অল্পের উপর দিয়ে আপদ বিদায় করতে পারছেন দেখে। তবে এতো অল্পের উপর দিয়ে যে হবে এটা তার কল্পনায়ও ছিল না।গল্প উপন্যাসের মামীদের মতো অতো খারাপ মামী তিনি নন। না হলে বয়সে বড় নিজের মেয়েকে রেখে কেউ ভাগনির বিয়ে দেয়। মামাদের তো কোনো চিন্তা নেই। তিনি উদ্যোগ নিয়ে ঘটক লাগিয়ে এই ডাক্তার পাত্র যোগার করেছেন। ঘটককে অবশ্য আগেই বলা ছিল, টাকাপয়সা খরচ করতে পারবেন না এক্ষেত্রে পাত্র দোজবরে হলেও আপত্তি নেই। তবে এখানে পাত্রের বৌ মারা গেছে একটা দু মাসের বাচ্চা রেখে। তাতে কি, ছেলে ডাক্তার এক্ষেত্রে এটুকু ছাড় দেয়া যেতেই পারে। তবে তিনি সবচেয়ে খুশি হয়েছেন ছেলে পক্ষ আগেই বলেছে ওরা কোনো অনুষ্ঠান চায় না। বর পাচ ছয় জন আত্মীয় নিয়ে এসে বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে চলে যাবে।কোনো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন না করতে। তবুও তিনি করেছেন।
ছেলে পক্ষ এলো দু’টো গাড়ি করে। দুটোই খুব দামি গাড়ি। প্রথমটা থেকে যে লোকটা নামলো যথেষ্ট মোটা এবং বেশ বয়স্ক। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট বিরক্ত এবং সে তার বিরক্তিটুকু লুকাচ্ছে না।”যা করার তাড়াতাড়ি করো, আমার চেম্বারে লোক বসিয়ে রেখে এসেছি, আর খাওয়ার জন্য আমাকে সাধাসাধি করোনা, জানইতো ওয়েলি ফুড আমার সহ্য হয়না।” দূর থেকে এটুকু শুনেই হাসান বুঝতে পারলো এটাই পাত্র। যে লোক তার নিজের বিয়েতে এসেই এতো বিরক্ত সে যে সারা জীবন কি করবে আল্লাহই জানে। বিয়েতে উপস্হিত থাকার ইচ্ছে টুকুও চলে গেলো হাসানের। ছাদের চিলেকোঠায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো হাসান।
বিয়ে যে এতো অল্প সময়ে হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি নিতু। ছেলের সাথে ছেলের খালা, খালু আর এক মামা এসেছেন। খালা খুব হাসিখুশী মহিলা। এসেই বললেন, ওমা এ মেয়ে তো দেখি একটুও সাজেনি। আমাদের রোহানের না হয় ২য় বিয়ে কিন্তু তোমার তো প্রথম। বলেই সুটকেস খুলে সব কিছু বের করে সাজাতে লেগে গেলেন নিতুকে। প্রথম দর্শনেই মহিলাকে ভালো লেগে গেলো নিতুর।
সমস্ত বিয়ের কাজ সমাপ্ত হয়ে গেলো মাত্র বিশ মিনিটে। খাওয়া দাওয়া হতে লাগলো আরও ঘন্টাখানেক। ব্যাস এবার যাওয়ার পালা। নিতু ব্যাকুল হয়ে তার ছোটমামাকে খুঁজছে, আজও রাগ করে খায়নি হাসান, কোথায় গেলো? ছুটকি ছাদ থেকে ডেকে নিয়ে এলো হাসানকে । হাসানের একটুও আসতে ইচ্ছে হয়নি। ওই মটকু লোকটাকে তার ভাগনির পাশে সে সহ্য করতে পারছেনা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলো লোকটা বাইরে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। যাক লোকটার মুখোমুখি হতে হবেনা ভেবে খানিকটা স্বস্থি পেলো হাসান। ঘরে ঢুকে খুব অবাক হলো হাসান, কি সুন্দর যে লাগছে নিতুকে, ঠিক যেনো লাল একটা পরী কিন্তু পাশে ওটা কে? যেনো রুপকথার রাজপুত্র। রোহান নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে হাত বাড়ালো, আমি রোহান,আপনি নিশ্চয়ই ছোটমামা। কি যে হলো হাসানের, বুকে জড়িয়ে ধরলো রোহানকে। কিছুই বলতে পারলো না।

নিতু কে বিদায় দিয়ে রাহেলা বেগমের বুকে খানিকটা খচখচ করতে লাগলো।বিয়েটা কি খুব ভালো দিয়ে দিলেন নিতুর। পুরো পঁচিশ ভরি গহনা দিয়েছে ওরা সাথে ডায়মন্ডের আংটি। তিনি মনে মনে হিসাব করেন কত টাকার শাড়ী গহনা ওরা নিতুকে দিয়েছে। টাকার অংকটা মনে মনে হিসাব করে তার মাথাটা গরম হয়ে যায়। ঘটক তো কয়েক বার তাকে ছেলে দেখার কথা বলেছিল, ছেলের কি কি আছে তাও বলার চেষ্টা করেছিল, এখন মনে হচ্ছে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আগে দেখলে নিতু কেন নিজের মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিতেন।

অনাড়ম্বর ভাবেই নিতুর গৃহপ্রবেশ হলো। রোহানের মা ছাড়া এ বাড়ীতে নিজের বলতে আর কেউ নেই। দু’টো কাজের লোক আছে। আর আছে দারোয়ান আর ড্রাইভার। খালা,খালু রাস্তা থেকেই তাদের বাসায় চলে গেছেন। নিতুকে তার মায়ের রুমে নিয়ে গেলো রোহান। নিতু পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন শ্বাশুড়ি মা।

চলবে…

-জাহেদা মিমি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *