পতঙ্গ

খাবার টেবিলে বসে আলমের মেজাজ খারাপ হলো। একগাদা সবজি আর ডাল, এসব কি মানুষের খাবার?

‘এইসব কি রানছো বাবুর মা? একপদ মাছ মাংস রানতে পারো নাই?’
‘ওমা, আপনেরে না ডাক্তার বলছে মাছ মাংস কম খাইতে? আপনের না হাই ব্লাড প্রেসার?’
‘তার জন্য খালি এক গামলা সবজি রানছো?’
কপাল কুঁচকে খেতে বসলো আলম। তার মেজাজ আরো খারাপ হলো যখন দেখল একটা মাছি খাবারের উপর উড়ছে।
‘তোমার বুদ্ধি কবে হইবো বাবুর মা? খাইতে বসছি আর মাছি উড়তেছে। জানলাটা বন্ধ রাখতে পারো না?’
রুমা একটা ওড়না দিয়ে খাবারের উপর মাছি তাড়াতে লাগলো।
‘আচ্ছা শুনেন, রাবেয়া আসছে বিকাল বেলা, আপনার সাথে নাকি দরকার।’
‘কিসের দরকার? কথা নাই বার্তা নাই, আইসা পরলেই হইব? ডাক দেখি। ‘
রুমা রাবেয়াকে ডেকে নিয়ে আসলো। রাবেয়া আলমের বড় বোনের মেয়ে। তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে, স্বামী সৌদিআরব থাকে।
রাবেয়া ভয়ে ভয়ে খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো।
‘কিরে তোর খবর কি? হঠাৎ ঢাকায় আইলি?’
‘মামা , আপনেগো জামাই বারবার ট্যাকার কথা জিগাইতেছে। দুই বছর তো হইয়া গ্যালো।’
‘মাত্র দুইলাখ ট্যাকার জন্য ফালাফালি করার কি আছে? আমি কি ট্যাকা মাইরা খামু? ভাগ্নির জামাইয়ের ট্যাকা আমি ক্যান মারমু? এইটুক বিশ্বাস নাই ? মাইনষের লাখ লাখ ট্যাকা আমার কাছে জমা আছে, তাগো খবর নাই আর তোর জামাই এই কয়টা ট্যাকার জন্য কইদিন পরপর তোরে ঢাকায় পাঠায়।’
আলমের হুঙ্কার শুনে রাবেয়া আরো জড়সড় হয়ে যায়। মাথার ঘোমটা টেনে ঠিক করে। রুমা খেয়াল করে মেয়েটার ঠোঁটেের পাশে কালশিটা। রুমা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।
‘এইবার ট্যাকা নিয়া না গেলে ওরা আমারে মাইরা ফেলবে মামা।’ রাবেয়া ক্ষীন স্বরে বলে।
‘কে মারবো ? কার এত বুকের পাটা ? আমার সামনে এইতে কইস। ছোটলোক সব!’
রাবেয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। মামার সামনে আর কিছু বলার সাহস পায়না।
রাবেয়ার স্বামী দুবছর আগে দেশে এসেছিল। তখন আলম তাকে ব্যবসার কথা বলে দুই লক্ষ টাকা নিয়েছে। রুমা জানে, আলম কতবার প্রতারক। সে মানুষকে খুব সুন্দর ভাবে ফাসায়। ইতিমধ্যে আলমের বড় ভাইয়ের কাছ থেকে দশ লাখ টাকার মত বাগিয়েছে, জীবনেও ফেরৎ দেবে বলে মনে হয় না। আলমের বাবা ফার্নিচারের ব্যবসা করে ভালো টাকা কামিয়েছিলেন, আলম সেখান থেকে অনেক টাকা সরিয়েছে ।তার বাবা ছোট ছেলে আলমের প্রতি দুর্বল ছিলেন, আলম সে দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে পুরোপুরি। তার বাবার মৃত্যুর আগে জালিয়াতি করে চার বিঘা জমি নিজের নাম করিয়ে নিয়েছে। আলমের বড় ভাই ভালো মানুষ বলে কিছুই বলেননি।
বড়ভাই আর বাবার কাছ থেকে টাকা পয়সা সম্পত্তি হাতানোর পর আলম অন্যদের ঠকানো শুরু করেছে । কাউকে বিদেশ পাঠানোর লোভ দেখিয়ে, কাউকে ব্যবসার কথা বলে অথবা জমি কেনার টোপ ফেলে নানা কায়দায় প্রতারণা করে টাকা আদায় করে নেয়। দুবছর আগে যখন রাবেয়ার স্বামী ইমরান দেশে এসেছিল তাকে খাতির শুরু করলো আলম! বাসায় এনে দাওয়াত খাওয়ানো , দামিদামি উপহার দেয়া। এসব আচরণ রুমার খুব চেনা, কোনো ভাবে ইমরানকে ফাসানোর পরিকল্পনা চলছে।ইমরানের হাতে তখন কিছু টাকা পয়সা ছিলো ।
একদিন বিকেলে রুমার সামনেই তো আলাপ করছিল আলম।
‘চায়নার ইলেকট্রিক মাল কিভাবে বিক্রি হয় তুমি জানো ইমরান? যে জিনিস বাংলাদেশী একশ ট্যাকা দিয়া চায়না থেইকা আনতে পারবা, সেই জিনিস সাতশ আটশ ট্যাকায় দেশে আইনা বেচতে পারবা। আমি গতমাসে চাইর লক্ষ ট্যাকা প্রফিট করছি। আমার বন্ধু চায়না যায় প্রতিমাসে, কন্টেইনার ভইরা মাল আনে , আমি খালি ট্যাকা দেই আর বলি কি ধরনের মাল চাই, বাকি সে সব জানে। কিন্তু এই ব্যবসা কিন্তু বেশিদিন টিকব না, বুঝলা? আরো বহুত মানুষ এই ধান্দায় আসতেছে, কইদিন পরে এই প্রফিট থাকব না, এখনি টাকা বানানোর সময়। তুমি কিছু ট্যাকা ইনভেস্ট করবা নাকি? ট্যাকার দায়িত্ব আমি নিলাম।’
ইমরান রাজি হয়ে দুইলাখ টাকা দিল। খালি বলল দুইলাখ টাকা ইনভেস্ট করে প্রতিমাসে যা লাভ আসে সেটা যেন গ্রামে তার মায়ের কাছে দেয়া হয়। আলম একবারও টাকা দেয়নি।
রাবেয়ার জন্য খুব খারাপ লাগে রুমার। মেয়েটার বয়স খুবই কম, স্বামী ছাড়া শ্বশুড় বাড়িতে কত কষ্ট করে থাকছে মেয়েটা। রাবেয়ার মামা টাকা দিচ্ছেনা বলে প্রতিদিন নানা কথা শুনতে হয়। ইদানিং গায়ে হাত তোলে তার শ্বাশুড়ি, ইমরানকে ফোনে নানা কথা বলে রাগিয়ে দেয়। ইমরান রাবেয়ার সাথে ফোনে ভালোভাবে কথাও বলে না। শুধু এক কথাই বলতে থাকে, ‘আমার টাকা উদ্ধার কর, নাইলে আমার সাথে আর সংসার করতে পারবা না। ‘

রুমার খুব মায়া হয় মেয়েটার জন্য। একটু আগে দেখে এলো ভেতরের ঘরে বসে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছে।
‘ইমরানের ট্যাকা গুলা ফেরত দিয়া দেন, মাইয়াটারে তার শ্বাশুড়ি খুব জ্বালাইতেছে ।’ পানের বাটা আলমের সামনে রেখে কথাটা বলে রুমা।
আলম খ্যাক করে ওঠে, ‘ যেইটা বুঝো না, হেইটা নিয়া কথা কইতে আসো ক্যান? ট্যাকা ব্যবসায় লাগাইলে কি কওনের সাথে সাথে ট্যাকা বাইর করণ যায়? ফাউল পোলাপানের সাথে কম করণ যায় না। এই কয়টা ট্যাকা দিয়া এখন দুইদিন পরে পরে বৌরে ঢাকায় পাঠায় দেয়, যত্তসব। ‘
আলম আয়েশ করে পান চিবায়। রুমা পানের বাটা সরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, বুক ভরে নিঃশাস নেয় , তাও কেমন দমবন্ধ লাগে ।
আলম কখনই রাবেয়ার টাকা ফেরত দেবে না, টাকাটা আলম মেরে দিয়েছে। কিছুদিন আগে যখন রুমার বাবার চিকিৎসার জন্য অনেকগুলো টাকার দরকার হলো, আলম তরিঘরি করে রুমার বাবার জমি বিক্রির নামে হাতিয়ে নিল। সেসময় রুমার বাবার অপারেশন করানোর জন্য টাকাটা এত জরুরি ছিল, রুমা অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। পরে অবশ্য সব বুঝতে পেরেছে, আলমের সাথে এটা নিয়ে কথা বলে দু চারটা চড়ও জুটেছে।
বারান্দার পাশেই তার ছেলে আরাফের ঘর। রুমা আরাফের ঘরে ঢোকে। আরাফ ঘুমাচ্ছে আরাম করে। পাশে রাবেয়া বসে আছে, কান্নায় চোখ ফোলা।
আরাফের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রুমা। ক্লাস টেস্টে খারাপ করেছে বলে একটু আগে খুব বকা দিয়েছে ছেলেটাকে। রুমা চায় ছেলেটা লেখাপড়ায় খুব ভালো করুক , ভালো মানুষ হোক । বাবার কালো ছায়া যেন কোনো ভাবেই ছেলের উপর না পড়ে।
রুমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো রাবেয়া।
‘মামী , কাল সকালে চইলা যাবো। কিন্তু বাড়িতে গিয়া কি বলব মামী , আমারে একটা বুদ্ধি দিবেন ? ‘
রাবেয়ার অসহায় মুখটা দেখে রুমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । আহারে কতই বা বয়স হবে, আঠার ঊনিশ। তাদের উপরের তলায় এইরকম বয়সী একটা মেয়ে কলেজে যায়, কি সুন্দর লাগে। আর রাবেয়া………..
‘রুমা এইদিকে আসো তো’ আলম ভারী গলায় ডাকছে। কেন ডাকছে রুমা বুঝতে পারে, রুমার শরীরটা এখন দরকার আলমের। ওর পা চলতে চায় না।

(২)
ভোরবেলা ফোনের আওয়াজ শুনেই রুমার বুকটা ধক করে উঠলো, এত সকালে কে ফোন করবে? কোনো খারাপ খবর নাতো ?
আলম ফোনে কথা বলছে আর হু হা করছে। ফোন রেখে আলম ভয়ংকর খবরটা দিলো , কাল রাতে রাবেয়া মারা গেছে !
‘কি বলেন আপনি, কয়দিন আগেই না আমাদের বাসা থেইকা গেল? ‘ রুমার শরীর কাঁপছে , চোখ কেমন অন্ধকার লাগছে।
‘এখন তারাতারি রেডি হও , আপা বারবার বেহুশ হইতেছে। আমাগো যাওয়া লাগবো ।’
বাড়িতে পৌছে ওরা দেখল লাশের গোসল করানো হয়ে গেছে। বাদ জোহর দাফন হবে। রাবেয়ার মা পাগলের মত প্রলাপ বকছে আর আছড়ে পরে কাঁদছে।
আলমকে দেখে রাবেয়ার মা চিৎকার  করে বলতে লাগলো ,’তোর জন্য মরছে আমার রাবেয়া , তুই টাকা দ্যাস নাই, তার জন্য রাবেয়ার শাশুড়ি আর দেবর আমার মাইয়াটারে খুন করছে। তুই দায়ী, তুই দোষী।”
সবাই তাকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আলমের মুখ কালো হয়ে গেলো।
‘কি কথা কসনা ক্যান? দে, এখন ওই বেটির মুখে দুই লক্ষ ট্যাকা ছুইড়া মার। ‘
খাটিয়ায় শোয়ানো রাবেয়ার শান্ত দেহ। খালি মুখটা বের হয়ে আছে। তার উপর ভনভন করছে দুচারটা মাছি।
‘গরমের দিনে মাছির যন্ত্রনায় থাকা যায় না ‘, আলমের মুখে কথাটা শুনে রুমা তাকালো, রাবেয়ার মুখের কাছে ঘুরতে থাকা মাছিগুলো আর নেই, সেগুলো এখন ঘুরছে আলমের মুখের কাছে আর আলম হাত দিয়ে সেগুলোকে তাড়াচ্ছে।
‘তুই আমার নিজের ভাই হইয়া আমার এত বড় ক্ষতি করলি? তুই কোনদিন সুখে থাকতে পারবি না, কোনদিন না…………’এরপর বিড়বিড় করতে করতে রাবেয়ার মা অজ্ঞান   হয়ে গেল।

রাবেয়ার দাফন শেষ করে আলম আর থাকলো না। মাছির যন্ত্রনায় সেখানে থাকা যাচ্ছিল না। যাওয়ার পথে রুমা লক্ষ্য করলো গাড়ির ভেতরেও মাছি! সারাক্ষণ ভনভন করছে আর আলম মহা বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে তাড়াচ্ছে।

‘আপনে সেদিন ট্যাকাটা রাবেয়াকে দিয়া দিলে আজকে এইরকম ঘটনা হইতো না। ‘ রাবেয়া নিচু স্বরে বলে।
‘তুমিও এইকথা বলতেছো। ডাক্তার সব পরীক্ষা করছে, রাবেয়ার জ্বর হইছিল, তার জন্য মরছে। ‘
‘সেদিন ঢাকা থেইকা ফিরার পরে ওর শ্বাশুড়ি ওরে খুব মারছে , রাবেয়ার সারা শরীরে অনেক দাগ ছিলো। এরপর ওর খুব জ্বর হইলো , দুইদিন তারে কোনো ডাক্তার দেখায় নাই, ঘরের মধ্যে ফালায় রাখছে। কখন মেয়েটা মরছে , কেউ জানেও না।’ রুমার গলা বন্ধ হয়ে আসে, চোখের সামনে রাবেয়ার চেহারাটা ভাসতে থাকে।
‘তুমি বলতেছো ওর শ্বাশুড়ি ওরে মাইরা ফেলছে? একটা মানুষরে মাইরা ফেলা এত সোজা? রাবেয়ার শ্বাশুড়ির গায়ে এত শক্তি যে কিনা ঠিকমত হাঁটতেও পারে না, সে মারলো আর আমার ভাগ্নি এত গর্দভ যে মাইর খাইলো চুপচাপ? যত্তসব আজাইরা প্যাচাল। এগুলা বাদ দিয়া গাড়ির জানলা খুলো, গাড়ির ভিতরে মাছি ভ্যানভ্যান করতেছে, খবর নাই। ‘
রুমা গাড়ির জানালা খুলে দিল। আলম রুমালে মুখের ঘাম মুছলো। হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়ালো।
‘শালা, দুনিয়ার সব মাছি আজকে আমার কাছে চইলা আসছে।’

(৩)
‘রুমা , তোমার কি ঘিলু সব পানি হইয়া গেছে? খাওয়ার টেবিলে এত মাছি ক্যান?’
‘কি মাছি, একটা মাছিও নাই, আপনি খালি মাছি মাছি করেন ক্যান?
‘কি কও তুমি? সব তরকারীর উপরে মাছি।’
আলম অস্বাভাবিক ভাবে হাত পা ছুড়ে মাছি তাড়াতে চেষ্টা করে। রুমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘরে মশা মাছি কিছুই নেই। গত কিছুদিন ধরেই আলম মাছি মাছি বলে অস্থির করে দিচ্ছে। সারা ঘর ফিনাইল দিয়ে ধোঁয়া হয়েছে, মাছি মারার ওষুধ দেয়া হয়েছে সবখানে। ঘরে মশা মাছি তেলাপোকা কিছুই নেই।
কিন্তু আলম অযথাই চিৎকার করছে। সারাক্ষণ হাত পা চুলকাচ্ছে। তার সারা গায়ে নাকি মাছি বসছে।
রুমা আলমের পাশে গিয়ে ওর হাত ধরলো, ‘কি হইছে আপনার?’
আলম হুঙ্কার দিয়ে বললো ‘ আমার কিছু হয় নাই, তোমার মাথা নষ্ট হইছে।’
আলম বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। মাছিগুলো তার সাথে সাথেই চলে, এখানেও মাছি ভনভন করছে। আলম হাত নেড়ে মাছিগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করতেই থাকে, কোনো কাজ হয় না। হঠাৎ মনে হয় মাছিগুলো ঠিক ভনভন করছে না, কিছু একটা বলছে। আলম প্রানপন চেষ্টা করে কিছু না শুনতে। সে ঘরের জানালা খুলে দেয়, একটা তোয়ালে নেড়ে মাছিগুলোকে বাইরে বের করে দিতে চেষ্টা করে।
গত কয়দিন ধরেই চেষ্টা চলছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না, মাছিরা তার পিছু ছাড়ছে না। আলম খেয়াল করলো সে আসলে বুঝতে পারছে মাছিগুলো ঠিক কি বলছে। সব মাছি যেন একই সাথে বলছে ,’তুই মৃত-তুই মৃত! ‘
আলম আতঙ্কে অস্থির হতে থাকে। সে যতই মাছি তাড়াতে চেষ্টা করে ততই যেন মাছির সংখ্যা বাড়তে থাকে, তারা আরো জোরে বলতে থাকে, ‘তুই মৃত! তুই মৃত!’
(৪)
হাটখোলায় একটা মার্কেটে আলমের ইলেক্ট্রোনিক্সের দোকান। টিপু নাম একটা অল্প বয়সী ছেলে সেটা দেখাশোনা করে। আলম মাঝে মাঝে সেখানে যায় খোঁজখবর নিতে। তার টুকটাক আরো ব্যবসা আছে, সবগুলোতেই ঢু মারে সপ্তাহে কননা কোনদিন।
টিপু খেয়াল করলো আলম অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে, কোনো কথা বলছে না। সাধারনত আলম যেদিন আসে, সেদিন দোকানের সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। আলম যতক্ষণ থাকে ধমকা ধমকি চলতে থাকে। হিসাবের খাতায় গরবর থাকলে তো দুচারটা চড় খাওয়াও আশ্চর্যের কিছু না। আজকে আলম একটা চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে গতরাতে ঘুম হয়নি। শরীর কেমন ফোলা ফোলা।
‘টিপু, পঁচা গন্ধ পাইতেছ?’
টিপু ঘাবড়ে গেলো। গত সপ্তাহে সে পেটি ক্যাশ থেকে পাঁচ হাজার টাকা সরিয়েছে। হিসাবের খাতায় মিথ্যা এন্ট্রি দিয়ে হিসাব মিলানো আছে , কিন্তু আলম টের পেয়ে গেলে সমস্যা।
‘জ্বী না স্যার , গন্ধ তো নাই। কালকেই তো দোকান পরিষ্কার করাইছি।’
‘না, গন্ধ আছে, আমি পাইতেছি।’
টিপু কোনো গন্ধ পাচ্ছে না। পাশের দোকানের মালিক গোপাল বাবুর দোকানে সব সময় ধুপ জ্বলে, ধুপের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো পঁচা গন্ধ না।
দুদিন ধরে আলম পঁচা গন্ধটা পাচ্ছে। আজকে মনে হচ্ছে গন্ধটা তার নিজের শরীর থেকেই আসছে। মাছি গুলো সব সময় তার আসে পাশেই থাকে। হয়ত এই পঁচা গন্ধের কারণেই থাকে। তার শরীরের উপর মাছি গুলো হাঁটছে টের পাচ্ছে আলম, কিন্তু তাড়াতে ইচ্ছা করছে না, ক্লান্ত লাগছে। তার শরীর অসম্ভব ভারী লাগছে, হাঁটতে খুব কষ্ট, যেন এই কয়দিনে ওজন অনেক বেড়ে গেছে। অথচ সে মাছির যন্ত্রনায় কিছুই খেতে পারে না, ওজন বাড়ার প্রশ্নই আসে না।
আলম বাসায় ফিরে যথারীতি খেতে পারল না। পেট গোলানো গন্ধের মধ্যে কিছুই খাওয়া সম্ভব না। রুমার সাথে অযথা চিৎকার করলো।
নিজের ঘরে ঢুকে এক বোতল পারফিউমের পুরোটাই প্রায় গায়ে মাখলো। তারপর রুমাকে ডাকলো।
রুমা ঘরে ঢুকে নাক চাপা দিল, সারা ঘরের পারফিউমের গন্ধে ভারী হয়ে আছে।
‘রুমা , গন্ধ পাইতেছ?’
‘কিসের গন্ধ? আমি তো সেন্টের গন্ধে দম নিতে পারতেছিনা। ‘
‘আমার শরীর পঁচতেছে রুমা, তুমি দেখো। ‘
রুমা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে , কি হলো লোকটার?
‘আপনার শরীর ঠিকই তো আছে, কি বলেন এইসব ?
‘মাছিরা বলছে, আমি মৃত। তার জন্য আমার শরীর পঁচতেছে। ‘

(৫)
গহীন কালো একটা কূয়া। সাধারণ কুয়ার চেয়ে অনেক বড়। তার ভেতরের দেয়াল ঘেষে অনেকগুলো কঠের ঘর, অনেকটা জেলখানার মতো। ঘরের সামনে টানা বারান্দা। ঠিক কয়তলা ঘর আছে বোঝা যাচ্ছে না। চক্রাকারে ঘরগুলো ঘুরতে ঘুরতে অসীমে মিলিয়ে যাওয়ার মত কুয়ার ভেতর হারিয়ে গেছে। সেই প্যাঁচানো বরান্দায় দাড়িয়ে নিচে গহীন কুয়ার দিকে তাকালে অন্তহীন অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। ভয়ানক ঠান্ডা আর কটু গন্ধে আলমের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
আলম প্রতিটা ঘরের দরজা খুলে খুলে ভেতরে দেখছে। সে খুব জরুরী কিছু একটা খুঁজছে। ঠিক কি জিনিষ, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কোনো ঘরেরই জরুরি জিনিষটা নেই।
কাঠের উপর মচমচ শব্দ করতে করতে আলম প্যাচানো বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে গহীন অন্ধকারের দিকে এগুতে থাকে।
হটাৎ ভনভন শব্দে অন্ধকার থেকে মাছিগুলো উড়ে এস আলমকে ঘিরে ধরে। আলম হাত নেড়ে মাছি গুলোকে তাড়িয়ে সামনের দিকে এগুতে চায়, তার জরুরি জিনিষটা খুঁজে পাওয়া খুব দরকার কিন্তু সামনে কিছুই দেখা যায় না।
তার চারপাশে একটাই কথা ঘুরতে থাকে, ‘তুই মৃত!’
আলম অনেক কষ্টে চোখ খুলে সামনে রুমা আর আরাফকে দেখতে পেল।
‘রুমা, আমারে ধরো , আমি ডুবতেছি।’
আলমকে অবাক করে দিয়ে রুমা হেসে উঠলো।
‘আপনে তো মারা গেছেন, আপনাকে আমি কেমনে তুলবো?’ বলে রুমা মুখ চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো। আরাফ হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছে, যেন খুব মজার কিছু হচ্ছে।
আলম বিস্ফোরিত চোখে দেখল সে কুয়ার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, হাত বাড়িয়ে রুমাকে ধরতে চেষ্টা করেও পারছে না। সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চেয়েও পারছে না, মাছিগুলো তার মুখের ভেতর এমনভাবে ঢুকে গেছে , কোনো শব্দ করা সম্ভব না। অগনিত মাছি প্রবল শক্তিতে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গহীন অন্ধকারে। চোখের সামনে কূয়ার বাইরের ক্ষীন আলো আস্তে আস্তে নিভতে লাগলো।

সে রাতেই ঘুমের মধ্যে মারা যায় আলম।ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত ব্লাড প্রেসারে তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো।

-সালমা সিদ্দিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *