পরী

[১]

এত দেরি হলো দরজা খুলতে, কী করছিলে, তুমি জানোনা আমি আজ আসব? 

ভ্রু কুচকে ভাবছি : কে এই মেয়ে?  কাকে চায়?  

মনের ভাবনা মুখে আনার আগেই দ্রুত মেয়েটি বাসার ভেতর ঢুকে গেল! 

দরজা ধরে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মেয়েটির ভেতরে যাওয়া দেখলাম । ভেতরে এসে মেয়েটি সরাসরি বেডরুমে গেল। বেডরুমে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে, ওড়নাটা বিছানায় রেখে ড্রেসিং টেবিলের টুলে গিয়ে বসল। 

টুলে বসে ডান পা বিছানার ওপর রেখে নূপুর খুলে ফেলল। এরপর চুল থেকে কাঁকড়া ব্যান্ডটা খুলল। ব্যান্ডটি খুলতেই সুজির প্যাকেট ফুটো হয়ে সুজি যেমন ঝর-ঝর,ঝর-ঝর করে পড়ে, তেমন করে চুলগুলো যেন ঝর ঝর করে পড়ল!  মেঝে ছুঁই ছুঁই করেও চুলগুলোর প্রান্ত মেঝে ছুঁলো না!  

হ্যাঙারে রাখা টাওয়েল নিয়ে যখন মেয়েটি ওয়াশরুমে  ঢুকল,তখনও আমি দরজায় দাঁড়িয়ে!

দরজা লাগাবো না লাগাবো না করতে করতে  দরজার বাইরে রাখা মেয়েটির ট্রলি ভেতরে এনে রেখে দরজা খুলে রাখলাম।

আমার দরজা খুলে দেওয়া, মেয়েটির প্রশ্ন করা, সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ওর পা থেকে নূপুর খুলতে দেখা, চুল খুলে ফেলা, ট্রলি ভেতরে এনে দরজার ভেতরে রাখা—এই একই কাজ আমি আজ ষষ্ঠবারের মতো করছি।

মেয়েটি এর আগেও এই একইভাবে আরও পাঁচবার আমার বাসায় এসেছিল। আজ আসাতে ষষ্ঠবার হলো।

সে প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিনের আগে তাকে আমি মোটেও চিনতাম না। আজও যে ঠিক চিনি, তাও না। তবে, মেয়েটি দ্বিতীয়বার আসার পর থেকে এটলিস্ট এটুকু বুঝতে পারি অসম্ভব মায়াবী চাহনির এ মেয়েটিকে আমার ভালো লাগে। দেখলে খুব মায়া লাগে। না দেখতে পেলে যেন মায়া আরও বাড়ে।

আজকের গল্পটা অসম্ভব মায়াবী চাহনির সেই মেয়েটির। 

[২]

সাল ২০১৮। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দিয়ে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে ঢাকায় এসে উঠেছি বন্ধুর বাসায়। প্ল্যান ছিল, বন্ধুর বাসায় দুই তিনদিন থেকে বাসা খুঁজে সে বাসায় উঠব।

কিন্তু ঢাকায় ব্যাচেলরদের জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া সহজ ব্যাপার না। খুব খোঁজাখুজি করতে হয়। টানা চারদিন সন্ধ্যার পর বেশ খোঁজাখুজি করে একটি বাসা পেলাম।

শহরের কেন্দ্রে, মেইন রাস্তার একদম পাশে খুব সহজে কম জামানত আর তুলনামূলক কম ভাড়ায় ৫ তলা বাড়ির ৫ তলাতেই একটি ফ্ল্যাট পেয়ে গেলাম। লিফট থাকলে সোনায় সোহাগা হতো, কিন্তু লিফট নেই! 

বন্ধুর বাসা থেকে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে উঠে গেলাম নতুন বাসায়। বাসায় থাকার জন্য বেশ ছিমছাম গোছের কিছু ফার্নিচার, হাতি-পাতিল এটা ওটাও কিনলাম। মোটামুটি মিনি সংসার সাজাতে যা যা লাগবে তার সব কেনা শেষে ছোট্ট একটি দুঃসংবাদ পেলাম। 

ঢাকায় আসার আগে কথা ছিল, আমার সাথে আমার একজন বন্ধু থাকবে। এ মাসেই পরীক্ষা শেষ করে সে আমার  সাথে যোগ দেবে। কিন্তু মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার ডেট পিছিয়ে যাওয়ায় সে উঠতে পারবে না বলে জানাল।

অগত্যা আমি ফ্ল্যাটে একাই থাকতে শুরু করলাম। 

ফাঁকা বাসায় একা একা ভালোই চলছিল। নিজেকে নিয়ে, নিজের ভাবনাগুলোকে নিয়ে, লেখালিখি নিয়ে একান্ত যে সময় দরকার হয়, তা এ নতুন বাসায় ওঠার পর বেশ ভালোভাবেই পাচ্ছিলাম। 

এদিকে,  একদিন নাট্যপরিচালক বন্ধু চারু হঠাৎ বাসায় এসে হাজির! এবার নাকি সে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার না বানিয়ে, ইদের জন্য রোমান্টিক নাটক বানাবে। আর স্ক্রিপ্ট নাকি আমাকেই তৈরি করে দিতে হবে!

বাসা পরিবর্তনের ব্যস্ততা তো ছিলই, তাছাড়া নতুন এক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখতে থাকায় বন্ধুকে রোমান্টিক নাটক লেখার প্রস্তাব প্রথমে না-ই করলাম। পরে আরেকদিন চারু বাসায় এসে আচ্ছামতো চেপে ধরায় রাজি না হয়ে পারলাম না।

বন্ধুর আবদার রক্ষায় একদিন খুব ভোরে উঠে গল্পের প্লট সাজাতে বসলাম। কিছুক্ষণ ভাবতেই ছোট্ট একটি শুরুও পেয়ে গেলাম।

মাথার ভেতর গল্পের প্লটটিকে একটু গুছিয়ে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম!

“একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে বছর খানেক হলো কাজ করছে তাইজুল। এই এক বছরে সে তার বসের খুব আস্থাভাজনদের একজনে পরিণত হয়েছে।  তাই বড়ো বড়ো প্রজেক্টগুলোর সিদ্ধান্তগ্রহণ পর্যায়ে এখন তাকে রাখা হয় । 

গত সপ্তাহে তাইজুলের পা মচকে যাওয়ায় সপ্তাহ ধরে অফিসের কাজ বাসাতে বসে অনলাইনেই করতে হচ্ছে আর জরুরি মিটিংগুলো সারতে হচ্ছে ভিডিয়োকলে । 

আজ তার বসের সাথে জরুরি মিটিং।

মিটিঙে কথা বলছে তাইজুল । কথা শেষ করার পর এখন বস তাকে প্রজেক্টের ডিটেইলস নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো বলছেন । তাইজুল ল্যাপটপের সামনে বসে শুধু মাথা ঝাকাচ্ছে। এই মাথা ঝাকানোর মাঝেই সে খেয়াল করে দেখলো : 

বারান্দার গ্রিলে কপালের বাম পাশটা ঠেকিয়ে, উদাস ভঙ্গিতে মুখটায় আসমানের কালো মেঘ জড়ো করে বসে আছে পরী । 

পরী; তাইজুলের অর্ধাঙ্গী। তাদের নতুন সংসার। আশেপাশের ফ্ল্যাটের ভাই-ভাবিরা সবাই বলাবলি করে, টুনাটুনির সংসার। তবে, কেউ যখন সামনাসামনি বলে : তাইজুল-পরীর টুনাটুনির সংসার, তখন পরী মনে মনে হেসে নিয়ে বলে :   টুনাটুনির সংসার না ছাই! আমাদের সারাদিন বাদরামির কারবার, সংসার-টংসার শুরুই করিনি ! 

সে যা-ই হোক, তাইজুলের আজ বসের সাথে মিটিং না হয়ে অন্য কারো সাথে মিটিং হলে পরীকে এমন বিষণ্ন দেখলে তখনই উঠে গিয়ে বসত তার পাশে। হয়তো জিজ্ঞেস করতো, সে মুখটা অমন করে রেখেছে কেন?

কিন্তু বস খুব জরুরি কথা বলায়, ল্যাপটপের সামনে থেকে উঠে যাওয়ার উপায় নেই!

এই শেষ হবে হবে করে মিটিং শেষ হচ্ছে না। এদিকে পরী এখনও অমন বিষণ্ন হয়েই আছে। অথচ, মিটিং শুরুর আগেও ও হেসে হেসে কফি দিতে এসে তাইজুলের এলোমেলো চুলগুলো নিজের হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিল। অথচ এখন কী মনমরা হয়ে বসে আছে।

শেষ হবে হবে করে পাক্কা ২৮ মিনিট পর বসের সাথে মিটিং শেষ হলো। মিটিং শেষ হতেই ল্যাপটপ বন্ধ করে তাইজুল দ্রুত পরীর কাছে গেল!

পরীর কাছে গিয়েই, তার চেয়ারের সামনে বসার মোড়া টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো, “কী ব্যাপার, হঠাৎ কী হলো এমন? মনমরা হয়ে বসে আছ কেন?”

পরী চুপ, কথা নেই! নড়লও না! শুধু একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাল! 
তাইজুল অবাক হয়ে বলল, “স্ট্রেইঞ্জ! কী হয়েছে বাবা বলো না, চুপ করে আছ কেন?  টেনশন হচ্ছে কিন্তু, চুপচাপ কেন, কিছু তো বলো”

পরী বারান্দার দরজা দিয়ে ডাইনিঙে রাখা ঘড়ির দিকে তাকাল! তাকিয়ে আবার আগের মতো হয়ে গেল!

আরে বাবা, বসের সাথে মিটিং ছিল, তোমাকে বলেই তো মিটিং শুরু করলাম! বস না হয়ে অন্য কেউ হলে মিটিং পোস্টপোন্ড করে তোমার এমন বিষণ্নতার কারণ আগেই জানতে আসতাম!  

তাইজুলের কথা শুনে পরী আবার ডাইনিং রুমের ঘড়ির দিকে তাকাল! কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উফ্ বলে শ্বাস ছেড়ে তাইজুলকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললো,

“আমার কিছুই হয়নি!”

আশ্চর্য! তাহলে এমন হয়ে ছিলে কেন? 

গতকাল যে একটা গার্লস গ্রুপে জয়েন করেছি না, ওই গ্রুপে এক আপুর লেখা পড়ে জানলাম, দৈনিক মিনিট তিরিশেক মন খারাপ করে থাকাটা নাকি ভালো! আমার মতো সারাদিন হিহি করে হাসে যারা তাদের জন্য এটা নাকি মুখের ভালো ব্যায়াম! এতে নাকি মুখের স্ক্রিনও সটান থাকে! পরী বলল।

তাইজুল কপাল ভাঁজ করে বললো, “আর কী কী লিখেছে সেই আপু?”

হাবিজাবি আরও লিখেছে, সেটুকু পড়িনি। এটুকু পড়েই ট্রাই করলাম! আমি তো সারাদিন হাসি, তাই ত্রিশ মিনিট ধরে ব্যায়ামটা প্র্যাকটিস করলাম! এ ব্যায়াম আমার জন্য টু টাফ! 
উফ্! আর করব না! 

 তাইজুল মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললো, “কেন করবে না?”

“মন ভালো থাকলে মন খারাপ করে থাকা যায় না, মন খারাপ থাকলে মন ভালো করে থাকা যায় “, পরী বললো।

তাইজুল অবাক হয়ে খেয়াল করল—পরী সারাদিন হাসাহাসি করলেও সময় সময় বেশ ওজনদার কথা বলে! যখন সে এরকম কথা বলে তখন সে আগের পরী থেকে একটু ডিফারেন্ট হয়ে যায়! পরীর চাহনি তখন কিছুটা গভীর, কিছুটা অচেনা আর কিছুটা … 

“আর কিছুটা ” পর্যন্ত লিখতেই কলিংবেল বেজে উঠল। 

এ ভোরবেলায় আবার আমার বাসায় কে আসবে, বোধ হয় ভুল করে কেউ কলিংবেল চেপেছে! এই ভেবে আবার লেখায় মন দিলাম। লেখা শুরু করতে না করতেই আবার কলিংবেলটা বেজে উঠল!

দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বাজে সকাল ৬ টা ১৫ মিনিট। 

লেখা বাদ রেখে দরজার খুলতে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছি, আমার বাসায় সারাদিন একজন লোকও আসে না। আজ এই সকালে আবার কে এলো? চারু না তো?  ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে দিলাম!

দরজা খুলেই দেখি একটুও সাজগোজ নেই, অথচ অসম্ভব পরিপাটি এক মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে! 

আমি কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই মেয়েটি বললো, “এতো দেরি হলো দরজা খুলতে, কী করছিলে, তুমি জানো না আজ আমি আসব?”

ভ্রু কুচকে ভাবছি,  কে এই মেয়ে?  কাকে চায়?  

মনের ভাবনা মুখে আনার আগেই দ্রুত মেয়েটি বাসার ভেতর ঢুকে গেলো! 

দরজা ধরে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মেয়েটির ভেতরে যাওয়া দেখলাম । ভেতরে এসে মেয়েটি সরাসরি বেডরুমে গেল। বেডরুমে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে ওড়নাটা বিছানায় রেখে ড্রেসিন টেবিলের টুলে গিয়ে বসলো। 

টুলে বসে ডান পা বিছানার উপর রেখে নূপুর খুলে ফেলল। এরপর চুল থেকে কাঁকড়া ব্যান্ডটা খুললো। ব্যান্ডটি খুলতেই সুজির প্যাকেট ফুটো হয়ে  সুজি যেমন ঝর-ঝর, ঝর-ঝর করে পড়ে, তেমন করে চুলগুলো যেন ঝর ঝর করে পড়লো!  মেঝে ছুঁই ছুঁই করেও চুলগুলোর প্রান্ত মেঝে ছুঁলো না!  

হ্যাঙারে রাখা টাওয়েল নিয়ে যখন মেয়েটি ওয়াশরুমে  ঢুকল,তখনও আমি দরজায় পজ মুডে দাঁড়িয়ে!

দরজার বাহিরে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ওনার সাথে আর কেউ আসছেন কি না? 

না, কেউ নেই! শুধু একটি ট্রলি! আমি ট্রলিটা ভেতরে এনে দরজার পাশে রাখলাম। রেখে, সরাসরি বাসার নিচে গেলাম। 

বাসার নিচে গিয়ে দেখি দারোয়ান চাচা সটান হয়ে শুয়ে নাসিকা সংগীতের সহিত ঘুমাচ্ছেন! 

ইঞ্জিন খারাপ গাড়ি ব্রেক করলে যেমন পেছন দিকে একবার আর সামনে দিকে দু’বার ঝাঁকি খেয়ে থামে, তেমন করে দারোয়ান চাচা আমার কয়েকবারের ডাক শুনে পেছন দিকে একবার আর সামনে দিকে দু’বার ঝাঁকি খেয়ে উঠলেন। 

আধো ঘুমে তিনি তার চোখজোড়া একটুখানি খুলে বললেন, “কের‍া বারে, সকাল হচে ? ত্যালে চারদিক এংকা আন্দার লাগিচ্চে ক্যা?”

আমি বললাম, “চাচা সকাল হয়নি, এখনও ভোর! আমি পাঁচ তলায় নতুন উঠেছি!”

চিনব্যার প্যাছি, এতো বেনা ? তা বাপ কী হছে? কুনো পবলেম ? দারোয়ান চাচা বললেন।

আমি মেইনগেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গেটে তালা ঝুলছে! তবুও জিজ্ঞাসা করলাম, “চাচা, এই ভোরে এক মেয়ে আসছে বাসায়! আমি তাকে চিনি না!”

চাচা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে, সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আমার ডান হাতের কবজি তার হাত দিয়ে ধরে বলল, “এনা আগেই মেইন গেটের তালা খুল্যা খাওয়ার জন্নে বাইরের কল থ্যাকা পানি অ্যানব্যার গ্যাছিল্যাম! এ্যার মদ্দেই মেয়েডা ঢুক্যা গ্যাছে!”

বাপজান তুমি ডরাবা না! সে শান্ত স্বভাবের মেয়ে, ভালো মেয়ে; নাম পরী।

পরী নাম শুনেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাই চাচাকে  বললাম, “মেয়েটির নাম কী বললেন ,  আবার বলেন তো?”

পরী! মেয়ের নাম পরী! চাচা বললেন।

আমি ভ্যাবলার মতো মুখ করে ভাবছি,  পরী তো আমার কেবল শুরু করা গল্পের… নাহ্, মে বি কো-ইনসিডেন্স! 

তুমি ফেলাটে যাও! যতক্ষুণ হামি না আসি ততোক্ষুন পরী যা কবি তাই করবা ! সে তোমার কোন ক্ষতি করবি না! এই বলে চাচা তার বিছানার নিচ থেকে টাকা আর চাবির গোছা লুঙ্গির গিটে রেখে পাঞ্জাবি পরতে পরতে মেইন গেটের দিকে হাঁটতে থাকলেন আর মেইনগেট পার হবার সময় আমায় ফ্ল্যাটে যাওয়ার ইশারা করে বাহিরে চলে গেলেন! 

আমি চাচার কথা কিছুই না বুঝে, আবার সিঁড়ির দিকে ছুটলাম।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি আর ভাবছি কে এই মেয়ে! কোথা থেকে এসেছে! আমার ফ্ল্যাটে কেন?

ভাবতে ভাবতেই ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে গেলাম।  ভেতরে ঢুকতেই কানে এলো, “আবিদ ট্রলি থেকে সাদা সালোয়ার আর নীল কামিজটি দাও! এই শুনছ! আবিদ , শুনছ! একটু তাড়াতাড়ি দাও!আবিদ  শুনছো?”

বেডরুমের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি, আবিদ কে?  এ কাকে ডাকছে মেয়েটি?

বেডরুমে ঢুকেই চোখ গেল ওয়াশরুমের দরজার দিকে!  মেয়েটি দরজার ফাঁক দিয়ে ভেজা হাত বের করে সালোয়ার আর কামিজ চাচ্ছে!

আমি জিজ্ঞেস করলাম: সালোয়ার আর কামিজ কোথায়?

মেয়েটা বললো ট্রলির ভেতরে।  

ট্রলিটা খুলে  সালোয়ার আর কামিজ খুঁজে মেয়েটির হাতে দিলাম। সে সেগুলো হাতে নিয়ে আবার ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিলো!

আমি বেডরুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে যেখানে লেখালিখি করছিলাম সেই টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। চেয়ারে বসতেই চোখ গেল কলমের দিকে, তারপর লেখার দিকে।  লেখার দিকে চোখ যেতেই গা ছমছম করে উঠল! আমি দাঁড়িয়ে গেলাম! মনে মনে ভাবছি এটা কীভাবে সম্ভব?

মেয়েটির নাম পরী, সে বারবার ডাকছে আবিদকে!কিছুক্ষণ আগে যে গল্প লেখা ফেলে আমি দরজা খুলতে গিয়েছিলাম সে গল্পের নারী চরিত্রের নামও আমি দিয়েছি পরী ! গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক! অথচ,  ঐ মেয়ের নামও পরী! আচ্ছা এত কো-ইনসিডেন্স হয়? 

নতুন বাসা, জিন- পরী টাইপ কিছু না তো? 
নাহ্, ভাবতেই গায়ের লোমগুলো শিউরে উঠছে! ভয়ও লাগছে ! 

ভয় নিয়ে দারোয়ান চাচাকে ফোন দিলাম।  ফোন ধরেই উনি কিছু না শুনেই বললেন, “বাপজান, ভয় পাবেন না, মেয়ের বাপজানরে খবর দেয়া হচে! উনি রওনা দিছে, আসিচ্চে ! আর মেয়েডা যা কয় তাই শুনেন, উনার বাপ না আসা পরজন্ত শুনেন! হামি বাসার নিচেই আছি! জরুরি দরকার হলে ফুন দিয়েন!” এই কথাটুকু বলে উনি রেখে দিলেন। 

আমি ফোন রেখে তব্দা খেয়ে মনে মনে ভাবছি,  কী সব ঘটছে, কিছুই বুঝছি না!

কিছুক্ষণ পরে, পাশের রুম থেকে বুঝতে পারলাম মেয়েটি ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে । আমি আমার লেখালিখির ঘরে চুপচাপ অথচ কান সজাগ করে বসে আছি ।

সে বেলকনিতে কাপড় শুকাতে দিলো। তারপর শব্দ শুনে বুঝলাম টুলটা টেনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে  বসল।  বোধ হয় সেখানে বসেই বলল, “আবিদ , কই তুমি? রুমে আসো! গোসল শেষ।”

পাশের ঘর থেকে আমি সব শুনছি আর মনে মনে ভাবছি, আবিদটা কে? এ বাসায় তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই!

নাহ্! মহা প্যাঁচ লাগিয়েছে তো মেয়েটা! কই থেকে কী হচ্ছে মাথাতেই আসছে না! 

আচ্ছা, মেয়েটা আমাকেই আবিদ ভাবছে না তো ?

হ্যাঁ। হতে পারে। বাসায় ঢোকার পর আমাকে ছাড়া সে তো অন্য কাউকে দেখেনি!
ইয়েস, ধরতে পেরেছি , মেয়েটি আমাকেই আবিদ ভাবছে!  কিন্তু আমি তো আবিদ নই। তাহলে..? 

আমার এ ভাবনার মাঝেই মেয়েটি আবার ডাকল,“আবিদ,এই রুমে আসো! শোনো, ট্র্রেনে দুইটা বখাটে খুব জ্বালিয়েছে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আসতে পারিনি, সারা রাত জেগে এসেছি! খুব টায়ার্ড লাগছিল, তাই গোসল করলাম। গোসল করার পর এখন ভালো লাগছে, শুনছ তো? 

[৩]

মেয়েটি একা একাই কথা বলছে। নাহ্, এমন করে কতক্ষণ চলবে। কথা বলে দেখি। বিষয়টা কী তা জেনে নিতে হবে। অপরিচিত একজনের বাসায় এসে উনি রীতিমতো নিজের বাসার মতো চলছেন, ফিরছেন! আর আমি দারোয়ানের কথামতো ভ্যাবল্যা দাশ হয়ে বসে আছি! নাহ্, এভাবে চলবে না,  যাই, দেখি কথা বলে..  

ল্যাপটপ শাটডাউন করে আমি চেয়ার ছেড়ে যেই না উঠব, অমনি মেয়েটা ও ঘর থেকে বলে উঠল, “তুমি ও ঘরেই থাকো , আমিই আসছি..”

আসছি বলেই মেয়েটি উঠে আমার বসা ঘরের দরজায় আসলো। দরজায় এসে ফ্যানের দিকে তাকিয়েই ‘আবিদ’ বলে চিৎকার করে উঠে ফ্লোরে পড়ে সেন্সলেস হয়ে গেল!

কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ মেয়েটির এমন হয়ে যাওয়ায় আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে কোনোমতে মেয়েটিকে তুলে বেডরুমে শুইয়ে দিয়ে  দারোয়ান চাচাকে ফোন দিলাম। 

দারোয়ান চাচা ফোন পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত আমার ফ্ল্যাটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “মেয়েডার বাপ পেরায় চল্যা আচ্চে! বাপজান আপনে মেয়েডার মুখোত পানি দ্যান, কিচুকখনের মদ্দেই ঠিক হয়্যা যাবি!

দারোয়ান চাচার কথামতো আমি পানির ঝাপটা দিলাম । ভয়ে হাত কাঁপার কারণে পানির ঝাপটা দেয়া ঠিকমতো হলো না!  তাই আবার দিলাম!  দিতেই মেয়েটির জ্ঞান ফিরে এলো! 

জ্ঞান ফিরে আসার পর মেয়েটি আমার দিকে একবার,  দারোয়ান চাচার দিকে একবার চাইল। তারপর কোনোমতে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসল।

এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে দারোয়ান চাচার দিকে চেয়ে বললো, “চাচা, আজ আবার আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম ! আই অ্যাম সরি! এক্সট্রেমলি সরি!”

দারোয়ান চাচা মৃদু হেসে বললেন, “আম্মাজান, কষ্ট আপনারো হচ্চে,  এনা এস্ট ল্যান! শুয়্যা পড়েন, হামরা আছি, ভয় নাই।”

এরপর আমাকে দেখিয়ে দারোয়ান চাচা বললেন,  “ইনি খুব ভালাে ছোল, ভয় নাই! এ বাসায় নতুন উঠছে। আম্মাজান আপনে এস্ট লেন!”

মেয়েটি জল ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকাল। কিছু বলতে চাইল, কিন্তু মুখ দেখে মনে হলো কী বলবে , তা সে বুঝে উঠতে পারছে না! 

একটুখানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকার পর, নিজেকে অসহায়ত্বের হাতে সোপর্দ করার মতো করে সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল।

দারোয়ান চাচা আমার হাত ধরে রুম থেকে বাইরে নিয়ে এলেন। তারপর বললেন, “সব ঘটনা কমুনি । মেয়েডা এস্ট লিক! চলেন বাপজান হামরা লিচে যাই , এতুক্ষনে মুনে হয় মেয়েডার বাপ আচ্চে।”

আমার সাথে কী ঘটছে, কেন ঘটছে কিছুই জানি না! যা ঘটছে সে ঘটনার ঠিক কোথায় আমি দাঁড়িয়ে অাছি, তাও বুঝছি না!  এই মনে হচ্ছে আমি মাঝ দরিয়ায় , এই মনে হচ্ছে কিনারায়, আবার এই মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে আমি এক জালে জড়িয়ে যাচ্ছি!

দারোয়ান চাচার সাথে সিঁড়ি বেয়ে যখন নিচে নামছি তখন মাথার ভেতর হরেক রকমের প্রশ্ন জড়ো হচ্ছে। এক ধাপ করে নামছি, আর একেকটা প্রশ্ন মাথায় আসছে! মাথার ভেতর প্রশ্নের সংখ্যা যেন এক্সপোনেন্টশিয়ালি বাড়ছে! আর সব প্রশ্নের উত্তর জানেন, এই দারোয়ান চাচা!

নিজেকে শক্ত করলাম। নিজেই নিজেকে বললাম, আর কোন ক্লাইম্যাক্স চলতে দেওয়া যায় না। নিচে নেমেই অাগে জানতে হবে ঘটছেটা কী! কে এই মেয়ে?

বাসার নিচে এসে দারোয়ান চাচা তার রুমে আমাকে বসতে বলে, মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন দিলেন। ফোনের ওপাশ থেকে কী কথা বলল বুঝলাম না, এপাশে চাচা, অ, অ আচ্চা খুলিচ্চি বলেই চাবি নিয়ে মেইন গেট খুলতে গেলেন। গেট খোলার মিনিট খানেকের মধ্যেই মার্সিডিজ বেঞ্চের একটি সাদা, আরেকটি কালো—এই দুটো ঝকঝকে গাড়ি এসে ঠিক গেটের সামনে থামল !

গাড়িগুলো থামতেই  সামনের গাড়ির ভেতর থেকে ৫৫ কি ৬০ বছর বয়সি এক ভদ্রলোক দ্রুত নামলেন। দারোয়ান চাচা তাকে সালাম দিয়ে বললেন, “স্যার, চিন্তার কিছু নাই, আম্মাজান এস্ট লিচ্চে! আপনে এই ছোলডার সাতে এন্যা কতা কন! ছোলডা খুব ধৈর্য ধর‍্যা আছে! হামি খালি নাম কছি, বাকিডা আপনে কন।”

দারোয়ান চাচার কথা শুনে উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি উঠে সালাম দিলাম। উনি মৃদু হেসে সালাম গ্রহণ করলেন। তারপর বললেন, “কী বলব বাবা! বলতে গেলে অনেক কিছুই বলতে হবে। চলো, তোমার ফ্ল্যাটে চলো, ওখানে বসেই সব বলছি।

আমি ভদ্রলোকের কথায় সায় দিয়ে তাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলাম। 

ফ্ল্যাটে এসে উনি সরাসরি বেডরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ মেয়েটিকে নীরবে দেখলেন। মনমরা হয়ে এরপর তিনি ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলেন! আমি পাশের সোফায় বসলাম। একটু পর উনি বলতে শুরু করলেন : আমি পারভেজ চৌধুরী। তোমার বেডে যে শুয়ে আছে আমি তারই বাবা। ওর নাম প্রিশা চৌধুরী পরী,  বোধহয় এতক্ষণে ওর নাম তুমি জেনে গিয়েছ!

জি, জেনেছি। দারোয়ান চাচা বলেছেন।

গুড,  পরী আমার একমাত্র মেয়ে। বড়ো হয়েছে ঢাকাতেই। তবে পড়াশোনা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট কিন্তু রাজশাহী। রাজশাহীর সাহেববাজারে আমার পৈতৃক বাড়ি আছে । ওর দাদা-দাদি, মানে আমার বাবা মা সেখানেই থাকায় পরী ওখানে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করত। পরীর মা’ও বেশির ভাগ সময় রাজশাহীতেই থাকত। আচ্ছা। তারপর? 
 তারপর, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরী যখন দ্বিতীয় বর্ষে তখন চতুর্থ বর্ষে পড়া আবিদ নামে এক ছেলের সাথে ওর পরিচয় হয়।

আমি তোতলানোর মতো করে বললাম, “আবিদ?” উনি এ নাম বলতে বলতেই তো অজ্ঞান হয়ে গেলেন! 

আমার কথা শেষ হতেই পরীর বাবার ফোন আসলো। এক্সিউজমি! বলে উনি ফোন ধরলেন।

ফোন ধরে উনি বললেন, “নো ডিয়ার, সি’জ ওয়েল নাউ! ডোন্ট ওরি! আই’ল ব্যাক অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল! ওকে ডিয়ার খল ইউ লেটার!

ফোন রেখে উনি বললেন, “পরীর মা ফোন দিয়েছিল!  যাই হোক,  কী যেন বলছিলে, বলো।”

আমি বললাম, ও কিছু না, আপনি বলুন; আবিদের সাথে পরীর পরিচয় হলো…  তারপর?

ও হ্যাঁ,  তারপর আবিদের কথা পরী মাঝে মাঝে বলত। তবে মাস দুই কি তিন পর যখন আবিদের কথাই আমাদের বেশি বেশি বলত তখন আমরা মুচকি হাসতাম, বুঝতাম এ ছেলেটা আমার মেয়ের কাছে স্পেশাল একজন হতে চলেছে !

তো, পরীর মায়ের চাপে পড়ে ছেলেটার খোঁজ নিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম আবিদ ছেলে হিসেবে নম্র,ভদ্র।  পরিবারও সম্ভ্রান্ত! 

এরপর পরীর মুখে আবিদের গল্প এক এক করে আমরা অনেকবার শুনেছি। অনেকবার মানে অনেকবারই!

বছর দেড়েক পর, আবিদ পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় চলে আসে। জব করতে শুরু করে।

এর মধ্যে আমরা খেয়াল করলাম,  আবিদ রাজশাহী ছেড়ে ঢাকা চলে আসার পর থেকেই পরী তার কাজ, কথা, চলাফেরা সবকিছুর মাঝেই আবিদকে টেনে আনে। খাবার , পোশাক, গল্প, গ্যাজেট যে কোন কিছুর গল্পই করুক না কেন সে গল্পে আবিদকে টেনে আনে!

সবকিছুতেই আবিদকে টেনে আনা, আবিদের প্রতি পরীর অতিরিক্ত ভালোলাগা, সেটা বুঝতাম আমরা! তবে, মাঝে মাঝে সেটা অন্যদের জন্যে বিরক্তির ছিল। অন্যদের কিছুটা সংগোপনে হাসির খোরাকও জোগাতো এ ব্যাপারটা। বাবা-মা হিসেবে আমরাও অনেক সময় বিরক্ত হতাম! তবে সেটা প্রকাশ করতাম না! একটানা কথাগুলো বলে গেলেন পরীর বাবা।

আমি বসে বসে শুনছিলাম । 

কথাগুলো বলে উনি টেবিল থেকে  পানির জার নিয়ে পানি খেলেন।  তারপর হেটে জানালার কাছে গিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বললেন, “একদিন রাতে পরীর মা’র সাথে পরীর এই “সবকিছুতেই আবিদকে টেনে আনা” নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়!”

এক পর্যায়ে পরীর মা রাগ করে এতে আবিদ, আবিদ করার চেয়ে পরীকে আবিদের কাছেই চলে যেতে বলে!

পরী; পরীর মা’র কথায় রাগ করে নিজের রুমে চলে যায়, দরজা বন্ধ করে দেয়। পরীর মা’ও নিজের রুমে গিয়ে কান্নাকাটি করে।

ঘণ্টা খানেকপর পরীর মা খাবার খাওয়ার জন্য পরীকে ডাকতে গিয়ে দেখে পরীর রুমে পরী নেই!  নেই, নেই মানে বাসার কোথাও নেই।  রাত তখন ১০ টা ছুঁই ছুঁই। 

আমি সেদিন ঢাকায় ছিলাম। ডিনার সেরে অফিসের পরবর্তী দিনের স্কেজিউলগুলো যখন ঠিক করছি , তখনই পরীর মায়ের ফোন পেলাম। সবকিছু জেনে বললাম, ওর রুমের আলমারি, ট্রলি ব্যাগ আছে কি না দেখো ! 

যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হলো, ট্রলি ব্যাগ, মোবাইল আর কিছু কাপড় নিয়ে সে চলে গিয়েছে!
পরীর নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখা গেল ফোন বন্ধ!

রেগে বোধহয় ফোন বন্ধ রেখেছে। সাথে সাথে আবিদকে ফোন দিলাম। আবিদ জানাল সে কিছু জানে না। ফোনে তাকেও কিছু জানায়নি।

রাত প্রায় ১২ টার দিকে আবিদের ফোন এলো। সে জানাল পরী মাত্র তাকে টেক্সট করে জানিয়েছে ট্রেনে সে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়েছে। ফোনে চার্জ নেই। সকালে হয় আপনার কাছে, না হয় আমার এখানে আসবে।

সেদিন পরী ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছে ভোর ৫ টায়। আমি স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়েছিলাম তবে ড্রাইভাররা পরীকে খুঁজে পায়নি! এই স্টেশন পরীর নখদর্পনে তাই সে পকেট গেট দিয়ে সেখান থেকে সরাসরি সিএনজি যোগে আবিদের এই বাসাতেই ওঠে।

আজ তুমি যেমন পরীকে দরজা খুলেছ আবিদও তেমন করে দরজা খুলেছিল।

আজ তোমার সাথে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, একটি ঘটনা বাদে সব ঘটনা সেদিন আবিদের সাথেও ঘটেছিল!

কোনো একটি ঘটনা আবিদের সাথে ঘটেছে যা এখনো আমার সাথে ঘটেনি?  আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

পরীর বাবা আমার চোখের দিকে কিছুক্ষন কী যেন দেখে শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আবিদ সেদিন খুন হয়েছিল!”

আমি তড়িৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম, “বলেন কী?”

পরীর বাবা বললেন, “ভয় পেয়ো না বাবা, বসো।  হ্যাঁ।
আবিদ সেদিন খুন হয়েছিল!

খেয়াল করে দেখো, আজকে সকালে পরী তোমার ওই  রুমের ফ্যানের দিকে তাকাতেই অজ্ঞান হয়ে যায়!

হ্যাঁ। ও আমার মাথার উপরের ফ্যানের দিকে তাকিয়েই ফেইন্ট হয়েছিল!

ঠিক। ফ্যানে তখন সে আসলে আবিদের ফাঁস দেয়া ঝুলন্ত দেহটা দেখেছিল!

ও মাই গড!  দ্যাট মিনস, এই রুমে আবিদ সুইসাইড করেছিল ?

না, সুইসাইড না। তাকে খুন করা হয়েছিল।

সরি! আঙ্কেল আমি বুঝছি না আপনার কথা ! এখনই বললেন, পরী ফ্যানে আবিদের ঝুলন্ত দেহটা দেখেছিল!  আবার বলছেন খুন হয়েছিল! প্লিজ, ক্লিয়ার ইট! 

হুম, ঘটনাটি না বললে বুঝবে না!  কী ঘটেছিল তা বলছি, তবে, একটু দাঁড়াও, তার আগে পরীর ডাক্তারদের আজকের ঘটনাটি ইনফর্ম করি নিই।

এক এক করে মোট তিনজন ডাক্তারকে ভিডিয়ো কনফারেন্সে নিয়ে আজকের ঘটনাটি ডিটেইলস বললেন পরীর বাবা।  বুঝলাম, পরী মোট তিনজন ডাক্তারের সম্মিলিত একটি টিমের অবজারভেশনে আছে!

[৪]

ডাক্তারদের সাথে কথা বলা শেষ করে উনি যা বলছিলাম একটু আগে,  বলে আবার বলতে শুরু করলেন :

সেদিন রাতে পরী রাজশাহী থেকে ঢাকা আসার যে ট্রেনে উঠেছিল! সে ট্রেনে দুইজন মাদকাসক্ত বখাটে ওকে ডিস্টার্ব করেছিল। ট্রেনে যাত্রী থাকায় বখাটে দুটো তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। 

ট্রেন যখন এয়ারপোর্ট স্টেশনে পৌঁছায় তখন ওই বখাটেদের হাত থেকে বাঁচতে পরী ট্রেন থেকে নেমে লুকিয়ে পকেট গেট দিয়ে বের হয়ে দ্রুত সিএনজিতে উঠে পড়ে। সিএনজিতে ওঠার পর পরী আর ওই বখাটেদের দেখেনি।  

আবিদের বাসায় পৌঁছানোর পর, বাসার মেইনগেট খোলা পেয়ে সে দ্রুত পাঁচ তলায় উঠে যায়।

পরী ভেবেছিল, বখাটেরা বোধহয় তার পিছু পিছু আসেনি। কিন্তু সেদিন বখাটেরাও তার পিছু পিছু এসেছিল। সিএনজি পেতে একটু দেরি হওয়ায় বখাটেরা পরীর সিএনজি থেকে একটু পিছিয়ে পড়ে। তবে শেষপর্যন্ত তারা বাসা পর্যন্ত এসে যায়!

বাসার মেইনগেট খোলা পাওয়ায় তারাও বাসার ভেতর ঢুকে যায়! ঠিক কোন ফ্লাটে পরী ঢুকেছে তা তারা জানত না! তবে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তারা এই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢোকে!

ভেতরে ঢুকে তারা আবিদের সামনে পড়ে যায় । আবিদ কোনো প্রশ্ন করার আগেই তারা দুজনে মিলে আবিদকে অতর্কিত আক্রমণ করে বসে! আবিদ সুঠামদেহী ছিল! দুজনে মিলে ওকে আটকে রাখা সম্ভব ছিল না, তার মধ্যে তারা ছিল মাদকাসক্ত।  

ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ওরা দুজন যখন বেকায়দায় তখন এদেরই একজন আবিদের চোখে জলন্তিমলম লাগিয়ে দেয়,  চোখে জ্বালা শুরু হলে ওই দুজন  আবিদের হাত থেকে ছুটে যায়! ছুটে গিয়ে একজন আবিদের মাথার পেছন দিকে রুমে রাখা জিম করা ডাম্বেল দিয়ে সজোরে আঘাত করে!

সে আঘাতেই আবিরের মাথার পেছনে গুরুতর জখম হয়, সে ফ্লোরে পড়ে যায়! আবির ফ্লোরে পড়ে যাবার পর, ওই দুজন ভয় পেয়ে আবিদকে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় । সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে তারা বোঝাতে চেয়েছিল,সবাই যেন ভাবে আবিদ সুইসাইড করেছে।

এ ঘটনার পুরো সময় ধরে পরী ওয়াশরুমে ছিল। ঝরনার পানির শব্দের জন্য সে কিছুই টের পায়নি! গোসল শেষে বের হয়ে পরী যখন ওই রুমে দরজার কাছে আসে, তখন আবিদকে ঝুলন্ত দেখেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়!

এই ঘটনা আমরা জানতে পারি যেদিন ওই মাদকাসক্ত দুজন পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। কী কী ঘটেছিল সেদিন তা ওই শয়তান দুটো পুলিশের কাছে তার সব বর্ণনা করে।

কিন্তু শয়তান দুটো পুলিশের হাতে ধরা খাওয়ার আগে ঘটনাচক্রে  আমার মেয়েকেই ‘আবিদের সুইসাইডে”র জন্য দায়ী করা হয়!

ওই সময়টাতে আবিদ যে আর নেই, এই ধাক্কাই পরী সইতে পারছিল না; তার মধ্যে আবিদের সুইসাইড কেইসে,  পুলিশের চোখে সে ছিল সন্দেহভাজনদের মধ্যে একজন!

ওই শয়তান দুটো ধরা পড়ার আগে পুলিশ , সাংবাদিক, আবিদের পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের প্রতিনিয়ত জেরার মুখে পড়ে ভেতরে ভেতরে পরীর মানসিকতা একেবারেই দুমড়েমুচড়ে যায়! 

শয়তান দুটো ধরা পড়ার পর সবকিছু থেকে পরী নিস্তার পেলেও কিছু দিনের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি পরীর ভাবনার জগৎ অন্যরকম হয়ে গেছে!

আবিদ যে বেঁচে নেই এটা হঠাৎ সে ভুলে যায়! যেদিন ভুলে যায়, সেদিন রাতেই সে প্রথম যেদিন ওর মা’র সাথে রাগ করে ঢাকায় আজকের এই বাসায় এসেছিল তেমন করেই সে যেখানেই থাকুক সেখান থেকে রওয়ানা দেয়! এই ফ্ল্যাটে পৌঁছে সে সবকিছু আগের মতোই দেখে! ফ্ল্যাটে যে থাকে তার ভেতর আবিদকেই সে দেখে। কেউ না থাকলেও তার মন-মস্তিষ্ক আবিদের অবয়ব সৃষ্টি করে ফেলে! 

আজকে তোমার বাসায় ও এসেছে এই কারণেই। আবিদের ঘটনাটির পর পরী দু’বার এ বাসায় এসেছিল। তোমার আগে ফ্যামিলি নিয়ে এক ভদ্রলোক এখানে থাকতো। তুমি এ বাসায় আসার পর পরী আজ প্রথম এলো, এর পর যে আর আসবে না তা বলতে পারছি না! ডাক্তার বলছেন, “সি ইজ ইমপ্রুভিং..! বাট আই থিংক দ্যা এন্ড অফ দ্যা রিপিটেড স্টোরি ইজ টু ফার!”

সব শুনে আমি পরীর বেডের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পরীর বাবাও চুপচাপ পরীর বেডের দিকে তাকিয়ে থাকল।

খানিকপর, নিরবতা ভেঙ্গে পরীর বাবা বললেন,“ইয়াংম্যান,  নাউ ডিসিশান ইজ ইয়োর্স! ইউ ক্যান হেল্প মি বাই এল্যাওয়িং দিস রিপিটেড স্টোরি, অর ইউ ক্যান হেল্প মি বাই লিইভয়িং দিস রিপিটেড স্টোরি!”

পরীর বাবার কথার অর্থ দাঁড়াল—এই ফ্ল্যাটে এই গল্প রিপিট হতেই থাকবে; আমি থাকলেও, না থাকলেও!
বসে বসে কিছুক্ষন ভাবলাম।

সেদিন নিজের সাহস বেড়ে গিয়েছিল কি না জানি না, তবে আমি খুব সাহসী নই। তবুও ভাবনা শেষে বলেছিলাম : দিস ডোর’স কি ইজ মাইন অ্যান্ড ডোর উইল বি ওপেন ফর দ্যা স্টোরি! 

সেদিন পরীকে তার বাবা নিয়ে যাওয়ার পর, পরী কখনো ১০ দিন, কখনো ২৫ দিন,কখনো একমাস পর পর আসতো!  ৬ষ্ঠ বারের মতো আসার পর পরী প্রায় তিন মাসের বেশি সময় আর আসেনি।

এই ছয় বারে পরী এসে ওই একই ঘটনা ঘটাতো! ঘটনায় তার ডায়লগ, ভাবসাব সব অপরিবর্তনশীল থাকতো , আর শুধু মনে মনে ভাবা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ থাকত না। প্রথম  যেদিন পরী এসেছিল সেদিনই শুধু যা বিরক্ত লেগেছিল, তারপরের দিনগুলোতে পরীর হঠাৎ আগমন খারাপ লাগত না। বরং, হঠাৎ কোনো এক সকালে দরজা খুলে পরীকে দেখতে পাওয়াটায় এক ধরনের ভালোলাগা জন্মাতে শুরু করেছিল !

সেই ভালোলাগা যত দিন গিয়েছে তত বেড়েছে! প্রতিবার পরী ওই রুমের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে অসুস্থ হবার পর যখন ওকে নিয়ে ওর বাবা চলে যেত তারপর থেকে তিন চারদিন আমার মন, হঠাৎ ঝড়ে কচি পুঁইশাকের ডগা যেমন দিশেহারা হয়, তেমন দিশেহারা হয়ে থাকত!

পরী আসবার পর থেকে রাত জেগে লেখালিখি বন্ধ করেছিলাম। দশটা, এগারোটার  মধ্যেই ঘুমিয়ে যেতাম, যেন ভোরে উঠতে পারি! 

সত্যি বলতে প্রতিদিন ভোরে উঠতাম, পরী আসবে এই আশায়!

আমি জানতাম  পরীর ডাক্তাররা ট্রিটমেন্টের পার্ট হিসেবে পরীকে স্বাধীনভাবে যেখানে খুশি সেখানে যেতে দেয় আর এই ফ্ল্যাটে পরীর নিজের ইচ্ছায় আসাও ট্রিটমেন্টের পার্ট ; তবুও অপেক্ষায় থাকতাম !

[৫]

পরীর জন্য সেবার আমার অপেক্ষা খুব দীর্ঘ হয়েছিল! মাস তিনেক পরী আসছিল না! পরীর বাবাকে ফোন দিয়ে জানলাম পরীর বাবার এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু যিনি কিনা নামকরা সাইক্রিয়াট্রিস্ট, তিনি ঢাকায় ব্যাক করায় পরীর ট্রিটমেন্ট এখন তার অধীনেই হচ্ছে। তার ট্রিটমেন্টে পরী বেশ ভালো রেসপন্স করছে! 

পরীর বাবার কথা শুনে মন খুব ভাল হয়ে গেল ; কিন্তু ব্রেইন বলল ব্যাটা মন খারাপ কর, পরী আর আসবে না এইটা ভেবে মন খারাপ কর!

ব্রেইনের কথাই ঠিক, দিন যত যায় মন ততে খারাপ হতে থাকে! রাত জেগে কবিতা লিখি, এলোমেলো জীবন যাপন করি, কখন ঘুমাই,কখন জাগি ঠিক নাই!    

এরই মধ্যে একদিন হলো কী, এই ফ্লাটে আবিদ খুন হয়েছে শোনার পর আমার যে খুব ভয় লাগতো সেরকম না!  কিন্তু একদিন..

“পরী এলো! 

আমি ওই দরজা খুলে বরাবরের মতো থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ।
পরী আগের মতোই ট্রলি বাহিরে রেখে বললো, “দরজা খুলতে এতো দেরি হলো কেন…………….? “

আমি চেয়ারে বসে ভাবছি, আজ ওই রুমের দরজা বন্ধ রাখব।  পরী যেন ফ্যানটাই না দেখে। দেখি কী করে..!

ওই রুমের দরজা বন্ধ করে আমি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলাম।

পরী কাপড় চাইল। 
দিলাম। 
গোসল শেষ করল। তারপর আগের মতোই ঘটনা ঘটতে থাকলো! 

একটু পর, পরী বেডরুম থেকে আমার ওই রুমের দিকে  যেতেই দেখল সে রুমের দরজা লকড। 

লকড দেখে পরী ডাকল আবিদ, আবিদ !  দরজা বন্ধ করেছ কেন, খোলো।

ড্রয়িং রুম থেকে আমি বললাম, “পরী, এই তো! আমি এখানে। এখানে আসো!

ড্রয়ং রুম ওই রুমের দরজার বিপরীত পাশে হওয়ায় আমার ডাকে পরী পেছন ফিরে তাকাল! আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, “তুমি ওখানে?” এই বলে সে আমার দিকে আসতে থাকল, একটু আসতেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা ধরলে যেমন করে মানুষ কপালের দুই পাশে চেপে ধরে তেমন করে সে চেপে ধরল! তারপর একটু পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাল!

খুব চেনা রাস্তা ভুলে গেলে মানুষ যেমন করে , দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরী তেমন করতে থাকল।

সোফায় বসে আমি ওর কার্যক্রম দেখে ডাক দিলাম।

পরী আমার ডাক শুনেই  চমকে উঠল। তারপর হাসতে হাসতে বললো, তুমি ওখানে! এতক্ষণ তোমাকেই তো খুঁজছিলাম ! পাচ্ছিলাম না। 

এই বলতে বলতে পরী দরজার সামনে থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসা শুরু করতেই ঘটল এক ঘটনা!

ও এক কি দুই পা সামনে বাড়াতেই ওর পেছনের দরজা একা একাই খুলে গেল! ও আমার দিকে যতই এগুতে থাকল দরজা ততই খুলে যেতে থাকলো!

দরজা আপনাআপনি খুলে যাওয়া দেখে আমি ভয়ে পরী বলে চিৎকার করে উঠে চোখ মেলে দেখি ভরা সন্ধ্যা! “

ভরা সন্ধ্যায় এ রকম  বাজে এক স্বপ্ন দেখে যখন উঠে পড়লাম তখন লাগতে শুরু করল ভয়! এ ভয় না সেই ভয়, ভয়ে আমি রাস্তার সাইডে ফেলে রাখা ইলেকট্রিক পোলের মতো সটান হয়ে শুয়ে রইলাম।  সেই রাতে বাসার সব লাইট অন করে রাখলাম। অাবিদের ওই ঘর লক করে রাখলাম। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম : এ ফ্লাটে আর থাকবো না।  আগামীকালই বন্ধুর বাসায় উঠব, আর আগামী মাসে নতুন ফ্লাটে!

[৬]

শুয়ে শুয়ে ভাবছি, কোনোমতে সকাল হলেই রওয়ানা হবো বন্ধুর বাসায়।  বন্ধুর বাসা, নতুন ফ্ল্যাট, পরী সুস্থ হয়ে গেছে এসব ভাবতে ভাবতেই সে রাতে ঘুমিয়ে গেলাম।

তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়ায় ঘুমও ভাঙল তাড়াতাড়ি। ঘড়িতে দেখি বাজে ৬ টা!

উঠে ফ্রেশ হয়ে গোছানোর জন্য ব্যাগ বের করতে করতেই কলিংবেল বেজে উঠলো।  

কলিংবেল বাজতেই পরীর কথা মনে পড়ে গেল! আজ আবার পরী আসলো না তো!

ব্যাগ রেখে দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলব অমনি খেয়াল করে দেখলাম আমার শরীরে বস্ত্রের সংকট প্রকট!

দরজার কাছ থেকে দ্রুত রুমে এসে ট্রাউজার আর  টি-শার্ট পরে তারপর গিয়ে দরজা খুললাম। 

দরজা খুলেই দেখি পরী! 

দরজা খুলতেই পরী পূর্বের মতোই বললো,
“এত দেরি হলো দরজা খুলতে, কী করছিলে, তুমি জানো না আমি আজ আসবো? 

তারপর আমি ওই দরজা খুলে বরাবরের মতো থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।

পরী আগের মতোই ট্রলি বাহিরে রেখে ভেতরে গেল! তারপর আগের মতোই সব ঘটতে থাকল! 

আমি চেয়ারে বসে বসে ভাবছি আজ ওই রুমের দরজা তো বন্ধ । দেখি পরী কী করে..!

ওই রুমের দরজার অপজিটে আমি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলাম।

সে কাপড় চাইল। দিলাম। গোসল শেষ করল। 

একটু পর, পরী আমার ওই রুমের দিকে যেতেই দেখল সে রুমের দরজা বন্ধ। দরজা লকড। 

লকড দেখে পরী ডাকলো আবিদ, আবিদ !  দরজা বন্ধ করেছ কেন, খোলো।

ড্রয়িং রুম থেকে আমি বললাম: পরী, এই তো! আমি এখানে। এখানে আসো!

পরী অবাক হয়ে বললো : তুমি ওখানে?  এই বলে সে আমার দিকে আসতে থাকলো, একটু আসতেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা ধরলে যেমন করে মানুষ কপালের দুই পাশে চেপে ধরে তেমন করে সে চেপে ধরল!

এরপর সে সোফায় আমার পাশে এসে ধপাস করে বসলো। আমার কাধে মাথা রাখতে রাখতে বলল :

” খিদে লাগছে খুব। বাসা থেকে রাগ করে বের হইছি, তাই কিছু খাইনি , ট্রেনেও কিছু খাইনি। কি খাবার আছে দাও!”

আমার কাধে পরী মাথা রাখায় আমি কিছুটা অস্বস্বিতে  পড়লাম। মুক্তি পেতে ওকে কাঁধ থেকে সরিয়ে উঠতে উঠতে বললাম: ব্রেড, জেলি,কলা হলে চলবে?

পরী সোজা হয়ে বসে বললো: আনো। চলবে।

আমি ব্রেড, জেলি,কলা ডাইনিঙে সাজিয়ে বললাম : এসো, চেয়ারে বসে খাও।

পরী মাথা নেড়ে না না জানিয়ে বললো: ওয়াটার বোটলে পানি ভরে,  দুটো ব্রেডে জেলি মাখিয়ে , কলা হাতে নিয়ে এখানে আসো ।  

আদেশমতো ব্রেড,কলা, পানি নিয়ে গিয়ে পাশে বসলাম। বসেই পড়লাম আরেক বিপদে ।  

খাবারগুলো ওর হাতে দিতে উদ্যত হতেই ও বলে বসলো:  তুমি তুলে খাওয়াও!

আমি ইতস্তত হয়ে বললাম:  তুলে খাওয়াব?

পরী বললো: হ্যাঁ!

ওর হ্যাঁ শুনে আমি চেয়ারে বসতে বসতে ভাবছি,  তুলে খাওয়ার অভ্যাসও নাই, তুলে খাওয়ানোর অভ্যাসও নাই! কী যে হয়!

কলা পিলিং করে বাম হাতে আর ব্রেড ডান হাতে
নিয়ে পরীর সামনে বসে আছি! কোনটা আগে দেবো, কীভাবে দেবো বুঝে উঠছে না! বছরে একদিন বার্থডে কেক তুলে খাইয়েছি অনেককে, কিন্তু ব্রেড, কলা তো খাওয়াইনি! এই সব হাবিজাবি ভাবছি যখন, তখন পরী বলে বসলো: কী ব্যাপার মুখে দাও! খাবার হাতে নিয়ে বসে আছ যে !

মুখটা ক্যাবলা করে আমি ব্রেডটা পরীর মুখের কাছে ধরলাম! সে খুবই অল্প করে একটুখানি মুখে নিল!

পরীর ব্রেড মুখে নেয়া দেখে ভাবলাম: আল্লাহ্! যেটুকু ব্রেড মুখে নিল তাতে এই দুই পিস ব্রেড খেতে তো ঘণ্টা খানেক লাগবে! মেয়েরা এত কম করে মুখে দেয়?

ভাবতে ভাবতেই পরী চোখের ইশারায় বোঝালো কলা দাও।

আমি কলা দিলাম। ওই সেই ট্রেডমার্ক বাইট! যে বাইট, তাতে একটা কলা খেতেও এ মেয়ের ঘণ্টাখানেক লাগবে!

এইটুকুন ব্রেড , আর তারও সামান্য কলা মুখে নিয়ে পরী এমন ভাবে মুখ নাড়াচ্ছে আর খাচ্ছে! মনে হচ্ছে যেন একটা আস্ত মুরগির ঠ্যাঙের মাংস তার মুখে! 

মিনিট খানেক পর আবার চোখের ইশারা!

ইশারায় রেসপন্স করতে আবার ব্রেড মুখে তুলে দিলাম! আগের বারের মতোই ব্রেড মুখে নিল, তবে এবার একসাথে দুবার নিল!

মনে মনে খুশিই হলাম। যাক ব্রেডটা তাড়াতাড়িই শেষ হবে তাহলে! ভেবেই, ইশারা করার আগেই কলাটা মুখে তুলে দিতে ধরলাম !

উঁহুঁ!  কলা না! ব্রেড বেশি নিয়েছি মুখে!

ওর উঁহুঁ শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে গেল, মেজাজ নড়বড়ে হয়ে গেল! উঁহুঁ শোনামাত্রই মনে চাইল যেন,  দুই তিন গ্রাসে কলা, ব্রেড খেয়ে মেয়েটাকে বলি, এইটা বলে খাওয়া, আর তোমার খাওয়া বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার মতো!

কিছু বললাম না, চুপচাপ থাকলাম। 

বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে পরী শক্তপোক্ত হয়ে চেয়ারে বসল। আমি কলা ব্রেড, নিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছি। ও ইশারা করলেই ব্রেড মুখে তুলে দেবো!

কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরী জিজ্ঞাসা করলো: তুমি কিছু খেয়েছ?

আমি মাথা নেড়ে না বললাম।

পরী আমার হাত থেকে ব্রেড আর কলা নিয়ে নিল।ব্রেডটা থেকে একটু ব্রেড ছিঁড়ে আমার মুখে তুলে দিলো। আমি হা করে পরীর দিকে তাকিয়ে আছি আর অবাক হয়ে খাচ্ছি।

খেতে খেতেই খেয়াল করলাম ব্রেড একটু তেতো তেতো লাগছে। পরীর হাত থেকে ব্রেড নিয়ে নাকে দিতেই বুঝলাম ব্রেডটা ভালো না!

পরীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্রেড খেলে কীভাবে?

পরী মৃদু হেসে বলল: মায়া বড্ড আজব জিনিস। সহজে জন্মে না, সহজে যায় না! 

এই দেখেন : আপনি আবিদ নন , আপনি অন্য কেউ! কত মায়া করেছেন কিন্তু সে মায়া আমার স্মৃতিতে জমছে না!

চেয়ার থেকে উঠে লাগিয়ে দেয়া দরজার সামনে গিয়ে পরী শান্ত গলায় বললো:  আবিদের মায়া সহজে যাচ্ছে না! আমি যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ি তাই আপনি দরজাটা বন্ধ রেখেছেন! কিন্তু, আমার মুক্তি যে দরজার ভেতরে আটকা! 

আমি পরীর কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ার থেকে উঠে ওর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। 

পরী আমার দিকে চেয়ে বলল: বাবা বলেছে, এ বাসায় আবিদের কাছে প্রথম যেবার এসেছিলাম তেমন করে আমি বেশ কয়েকবার নাকি আপনার এখানেও এসেছি। যে কয়বার এসেছিলাম অসুস্থ হয়েই এসেছিলাম, তাই সেসব আমার খুব একটা মনে নেই।

আজ কিন্তু অসুস্থ হয়ে আসিনি। আমি সুস্থ। বেশ ভালো সুস্থ। বাবা, নিচের দারোয়ান চাচা জানেন আমি আজ আসব। আপনাকে জানাইনি ; কারণ আমার সাথে কী কী হয়েছে গত দিনগুলোতে, প্রত্যেকবার আসায় আপনি কী কী করেছেন আমার জন্য তা দেখতে মন চেয়েছে। আপনাকে দেখলাম। আমার জন্য চোখে মায়াও দেখলাম! 

দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে প্রশ্বাসের সাথে শব্দগুলো মিশিয়ে মিশিয়ে যেন কথাগুলো বললো পরী। আমি চুপপচাপ শুনলাম।

একটু দম নিয়ে পরী বললো:  আজ আরেকটু কষ্ট করবেন আমার জন্য? প্লিজ? 

হ্যাঁ হ্যাঁ। প্লিজ বলুন। আমাকে কী করতে হবে? 

আমি এখানে আজ আবিদের ঘোর কাটাতে এসেছি, আপনি শক্ত থাকবেন, আমার কী হবে তা জানি না। আপনি অবশ্য দেখেছেন এর আগে। আজ যে ফেইন্ট হয়ে যাবো না তা তো আগেভাগে বলতে পারি না!

ফেইন্ট হবেন কেন? আপনি তো বললেন, আপনি সুস্থ। 

হুম! তা বলেছি, তবে….!

তবে? : আমি বললাম।

পরী বললো: দরজাটা খুলে দিন!

আমি বললাম: দরজা খোলার কী দরকার?  আপনি তো এখন সুস্থই। 

পরী বললো: ওি যে বললাম, আজ আমি আবিদের ঘোর কাটাতে এসেছি! 

আমি কিছুক্ষন এটাওটা ভেবে দরজা খুলতে উদ্যত হতেই পরী আমার বাহু ধরে টলটলে চোখ নিয়ে  বলল, দাঁড়ান একটু,আমার ভয় লাগছে! 

আমি বললাম: তাহলে খুলব না?

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে চোখ মুছে পরী বললো: না, দরজা খুলুন!

আমি পরীর দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খোলার আগে বললাম: পরী, ভয় নেই। এর আগে আপনাকে এখানে একটা ঘোর টেনে এনেছে, আজ আপনি নিজেই সে  ঘোর কাঁটাতে এসেছেন। ইউ আর অ্যা ব্রেভ গার্ল!

থ্যাংক ইউ : পরী বললো।

দরজা খুলে দিয়ে আমি পরীর পিছনে দাঁড়ালাম। পরী রুমের ভেতরে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম: পরী, ফেইস দ্যা সিচুয়েশন! বিলিভ মি,  ইউ উইল উইন ইট!

পরী এখন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, যেখানে দাঁড়াতেই এর আগে পরী ফেইন্ট হয়ে যেত!

আমি আবার ইশারায় বললাম:  দরজা দিকে মুখ করে তাকাও!

পরী পাশ ফিরে দরজার নিচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ তুলে ফ্যানটির দিকে তাকাল!

তাকানোর একটু পরই মৃদু কাঁপতে শুরু করল পরী। কাঁপুনি একটু বাড়তেই নিজেকে সে সামলে নিল! কিছুক্ষন ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল!

আমি এগিয়ে গেলাম না! চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মানুষ মারা যাবার সাথে সাথে নিকটজনেরা যেমন কান্না করে পরী এখন তেমন করে কাঁদছে। পরী কান্না করুক। প্রাণ ভরে কান্না করুক।

ঘণ্টাখানিক পর পরী স্বাভাবিক হলো। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে বসলো ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে। সেখান থেকে বসে সেই রুমের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। 

পাশের চেয়ারে বসে খেয়াল করলাম, পরীর এখনকার তাকিয়ে থাকাটা স্বাভাবিক। আগের মতো না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েই সে দেখছে। ইচ্ছে হলে তাকাচ্ছে, না হলে তাকাচ্ছে না।  ভয় নেই চোখে, যেন ঘোর কেটে গেছে!

পরী! 

আমার ডাক শুনে ফ্যান থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো : হ্যাঁ! 

কেমন বোধ করছেন এখন?

পরী স্ফিত হেসে বললো: খারাপ লাগাটা কাটেনি, তবে ওই রুম, ঐ ফ্যান, বাকি সব ঘটনাগুলোর প্রভাব নেই! আমি ওইসব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না! যা করছি এখন তা আমার ইচ্ছাধীনে ঘটছে!  

কথাগুলো বলতে বলতে পরীর চোখে আবার পানি চলে এলো! দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে পরী তার দুই হাত ডাইনিং টেবিলে রাখা আমার বাহুর উপর রেখে বললো : 

আপনাকে অনেকদিন বেশ কষ্ট দিয়েছি, জ্বালিয়েছি! বাবা বলেছেন সেসব দিনে আমি কী কী করেছি, দারোয়ান চাচার কাছেও শুনেছি আপনি আমার ভালোর জন্য কোনোদিন পিছপা হননি!

না, তেমন কিছু করিনি!  উনারা আপনাকে একটু বাড়িয়ে বলেছেন! : আমি বললাম।

ইউ আর অ্যা জেন্টেলম্যান! পরী বলল।

বাহুটা সরিয়ে নিয়ে বললাম: পরী, বাদ দেন তো এসব! সকালে তেমন কিছু তো খাওয়া হয়নি আপনার। আপনি বসুন, রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনছি! ওয়েদারটা খিচুড়ি খাবার জন্য তৈরি হচ্ছে! মেঘ করেছে, বৃষ্টি হবে। 

পরী জানালা দিয়ে বাইরে দেখে বলল, তাইতো! বেশ মেঘ করেছে ! ঘরের ভেতরে লাইট দেোয়া থাকায় , বাইরে যে অন্ধকার হয়ে আসছে, খেয়ালই করিনি !

হুম! বেশ মেঘ করেছে। পরী, আপনি বারান্দায় গিয়ে বসুন। আমি দ্রুত গিয়ে বাহির থেকে খাবার আনছি ! 

পরী হাসতে হাসতে বললো: বৃষ্টি না নামতেই খিচুড়ি খাবেন? আগে বৃষ্টি নামুক! তার আগে ছাদে চলেন, বৃষ্টির আগের বিষণ্ন আকাশ দেখি!

ছাদে?

হুম ছাদে! : পরী বললো।

ঠিক আছে চলুন। 

বৃষ্টি নামবে নামবে করে বৃষ্টি নামল না! কোথাকার বাতাস এসে যেন সব মেঘ উড়ে নিয়ে চলে গেল আসমানের এক কোণে ! মিনিট দশেকের মধ্যেই পুরো ছাদ রোদের ঝলমলে আলোয় ভরে উঠল! 

পরী ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে বাচ্চাদের মতো ছোটাছুটি করে গায়ে রোদ মেখে বেড়াচ্ছে আর এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে। ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে ছোট্ট এক জায়গায় রোদ নেই, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি সব শুনছি।

ছায়ায় দাঁড়াতে দেখে হাসতে হাসতে পরী বললো: কি, খিচুড়ি খাবেন না?  

আমিও হাসতে হাসতে বললাম: আর, খিচুড়ি! বাপরে! কী রোদই না উঠেছে!

আমার কথা শুনে পরী আরো খানিকক্ষণ হাসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো: আপনি কি জানেন এ বাসার গ্রাউন্ড ফ্লোরে ডাক্তান আঙ্কেল , বাবা, মা অপেক্ষা করছেন,  অ্যাম্বুলেন্সও এনে রাখা হয়েছে?

না। জানি না তো। ুনারা এসেছেন কেন?

আজ আমার বিরাট বিপদও হতে পারে। আমি পারমানেন্টলি সিক হয়ে যেতে পারি, সেজন্য।

হুম! বুঝতে পেরেছি।

চলুন বাসায় যাই, তারপর নিচে যাবো : পরী বললো।

ওকে। চলুন।

বাসায় এসে পরী ট্রলিটা গুছিয়ে নিল। রুম থেকে বের হয়ে সেই ফ্যানের দিকে একটু তাকিয়ে থাকল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো: চলুন, নিচে সবাই অপেক্ষা করছে!

আমি পরীর হাত থেকে ট্রলিটা নিয়ে বললাম, চলুন।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখি,  সবাইকে চেয়ারে বসতে দেয়া হয়েছে! 

পরী নিচে নামতেই পরীর আম্মা এসে জড়িয়ে ধরলো পরীকে!

আমার হাত থেকে ট্রলিটা নিয়ে গেল ওদের ড্রাইভার। পরীর বাবা আমি একে একে ডাক্তারদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন । একটু পর পরীর আম্মার সাথেও পরিচিত হলাম। তিনি আমার সাথে কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন! 

বাহির থেকে ড্রাইভার মতোন একজন পরীর বাবাকে এসে বললো :  স্যার, বাইরে আবার মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামতে পারে!

বৃষ্টি নামবে দেখে পরীর বাবা সবাইকে গাড়িতে উঠতে বললেন । গাড়িগুলো একেকটা যেন সদ্য শোরুম থেকে আনা হয়েছে। চকচকে আর নামিদামি ব্র্যান্ডের সব গাড়ি। মনে মনে ভাবছি, বাসার সামনের রাস্তায় বিমান নামার স্পেস থাকলে পরীর বাবা বোধহয় বিমান নিয়েই আসতেন!

যাক সে কথা! সবাই বিদায়ি কথোপকথন শেষ করে  একে একে গাড়িতে উঠলেন। পরীও উঠল!   আবার একটু পর নেমেও এল!

নেমে এসে হাসি রহস্য মিশেল করে বললো: জীবন বড্ড অদ্ভুত! অফিশিয়ালি পরিচয়ই হয়নি আপনার সাথে অথচ কত কথা হয়েছে, তাই না?

পরীর চোখে চোখ রেখে অাস্তে করে বললাম: হুম। 

পরী হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো : আমি প্রিশা চৌধুরী,  নিকনেম  পরী!

পরীর হাত বাড়িয়ে পরিচয় হতে চাওয়া দেখে আমার ভেতরটা নিমেষেই খোলা ময়দান হয়ে গেল!

যাকে এতদিন ধরে মনে মনে পছন্দ করি, যার জন্য মায়া হয় সে তো সত্যি সত্যিই আমাকে চেনে না!

অথচ, কত কী ভেবে বসে আছি!

সম্মান দেখিয়ে এমনিতেও আমি মেয়েদের সাথে হাত মিলিয়ে পরিচিত হই না, তার মধ্যে পরীর বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রেখে যে নিজের নাম বলতে হবে তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না!

তাই অভ্যেসবশত দুহাত পেছনে নিয়ে বললাম: আমি রেডন। 

পরী হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো : বাহ্! খুব সুন্দর নাম। বাবার মুখে অনেকবার শুনেছিলাম আপনার নাম। তবে আপনার মুখে নামটির স্পষ্ট উচ্চারণটা শুনতে বেশি ভাল লাগলো।

বাই দ্যা ওয়ে ; রেডন, ভাল থাকবেন।  আজ আসি। টেক কেয়ার।

চুপসে যাওয়া স্বর নিয়ে বললাম:  জি, আপনিও।

একে একে গাড়িগুলো চলে গেল।  শেষে গাড়িতে পরী ছিল। সে গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

পরী সুস্থ হওয়ায় দারোয়ান চাচা  বেশ খুশি হয়েছেন। তার দায়িত্বে গাফিলতির কারণ তাকে পীঁড়া দিয়েছে এতদিন। আজ একটু শান্তি পাচ্ছেন।

সিঁড়ি বেয়ে দুই তলায় উঠতে উঠতেই  পরপর দুটো বিদ্যুৎচমক দিয়ে জোরেশোরে ডাক পড়ল! শুরু হলো বৃষ্টি। ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছে করছে না বলে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। সিঁড়িতে বসেও শুধু পরীর কথাই মনে পড়ছে। আর যত মনে করছি, তত খারাপ লাগা বাড়ছে! 

সিঁড়িতে বসে মন বেশি খারাপ হওয়ায় উঠে পড়লাম ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে গিয়ে কানে নূপুরের শব্দ এলো! 

নূপুরের শব্দে কিছুটা অবাক হয়ে দরজা লাগানো বাদ দিয়ে বেড রুমের দিকে তাকিয়ে দেখি : পরী টুলে বসে ডান পা বিছানার উপর রেখে নূপুর খুলছে ! নূপুর খুলে চুল থেকে কাঁকড়া ব্যান্ডটা খুলল। ব্যান্ডটি খুলতেই সুজির প্যাকেট ফুঁটো হয়ে  সুজি যেমন ঝর-ঝর, ঝর-ঝর করে পড়ে, তেমন করে চুলগুলো যেন ঝর ঝর করে পড়ল!  মেঝে ছুঁই ছুঁই করেও চুলগুলোর প্রান্ত মেঝে ছুঁলো না!

খায়রুল ইসলাম নিয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *