প্রেটি ইন পিংক

(১)

ডাক্তারের কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, “আপনি বন্ধ্যা না আবার বন্ধ্যা।”একটা মানুষ দুটো জিনিস কি করে হয়? হয় সে বন্ধ্যা হবে নাহলে উর্বর। একটি মেয়ে ঋতুমতী হবার পরে প্রতি মাসে তার একটি করে ডিম উৎপাদন করবার কথা। কিন্তু এই পৃথিবীতে কিছু মেয়ে চরম দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে। তাদের উৎপাদিত ডিমের সংখ্যা নির্দিষ্ট। ধরা যাক যৌবনের পুরো সময় তারা ১২ টি ডিম উৎপন্ন করবে, অথচ এটা তাদের মাত্র এক বছরে করবার কথা। আমার বয়স ৩০ পেরোতে চলল। এদেশে ডাক্তাররা ৩০ পার হবার পরে কোন নারীর গর্ভবতী হবার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর।এর মাঝে গত পাঁচ বছর আমি আমার স্বামীর সাথে রয়েছি। বিয়ের পর প্রথম ২ বছর আগে আটকে যাই ভিসার জটিলতায়। সেই সময় আমার স্বামী নিয়মিত আমার কাছে এসেছে। এমনকি এক মাসে দুবার এসেছে। আমার স্বামী আমেরিকায় ব্যবসা করে। সে দেশের নিয়ম হলো এপ্রিলের ১৫ তারিখে আপনাকে সব কর পরিশোধ করতে হবে।এদিকে আমাদের খুব ইচ্ছা ছিল দেশের দু’বছরে বাচ্চা জন্ম দিয়ে একটু বড় করে আমেরিকা নিয়ে আসা। কিন্তু একটি মেয়ে সারা মাসে মাত্র একটি দিন উর্বর থাকে। আমার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও ভয়াবহ। মাসের সেই বিশেষ সময়টা সব মেয়ের জীবনে আসে একবার,আমার জীবনে প্রতি মাসে সেই বিশেষ সময় আসে একাধিকবার। এটা যে একটা কি ভীষণ ঝামেলার ব্যাপার আপনারা ভাবতেই পারবেন না। এটা নিয়ে আমাকে পড়ালেখা করতে হয়েছে, দৈনন্দিন জীবনযাপন করতে হয়েছে। প্রায়ই আমি রক্তশূন্যতায় ভুগতাম। মাঝে মাঝে এত দুর্বল লাগত, হয়তো পড়া বাদ দিয়ে অবেলায় শুয়ে থাকতাম। প্রাইভেট টিউটর বাসায় এসে বকাঝকা করতো, পড়া তৈরি করে রাখিনি বলে।

(২)

একটু বয়স বাড়লে আমার ভাবী আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার সব শুনে এক অদ্ভুত প্রেসক্রিপশন দিল। প্রথমে ব্যাপারটা নিয়মিত করবার জন্য স্বল্পকালীন সমাধান হিসেবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি দিল, আর দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান হিসেবে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলল। ডাক্তারের ধারণা ছিল বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে আমি এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।

(৩)

ডাক্তারের কথা শুনতে যেয়ে আমরা একটা ভীষণ অন্যায় করি। একটা নীরিহ ছেলেকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলি। সে আমাকে যখন বিয়ে করবার জন্য পছন্দ করে, তখন তার ধারনায় ছিল না কত বড় একটা জটিল ব্যাপারের ভিতর সে জড়িয়ে পড়ছে। এবং এই অজ্ঞতার মাশুল তাকে দিতে হচ্ছে গত সাত বছর।

(৪)

আমাদের বিয়ে হয় শীতকালে। বিয়ের পর ও মাত্র ৭ দিন দেশে ছিল। পুরোটা সময় আমরা খুব বেড়িয়েছি। একদিন নটরডেম কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। দেখি ফুটপাতের শিশু গুলি শীতের সকালের রোদে হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে। ধুলোবালিতে সারাদিন গড়াগড়ি করবার জন্য ওদের চুলগুলো সব লাল হয়ে গেছে। সেই লাল চুলের উপর শীতের সকালের রোদ যখন পড়ছে, সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। দেখি আমার স্বামী সেই শিশু গুলোর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো, কারন সেই মুহূর্তে আমি জেনে গেলাম আমার স্বামী কি চায়। ওর চোখ যেন কথা বলছিল।

(৫)

আপনাদের আগেই বলেছি একটি মেয়ে মাসে মাত্র ২৪ ঘন্টা উর্বর থাকে। এটা সচরাচর ঘটে মাসের সেই বিশেষ সময়টি শেষ হয়ে যাবার পরপরই। সেই সময় মেয়েটির শরীরটাও খানিকটা উত্তপ্ত থাকে। মনে হয় যেন জ্বর এসেছে। আমার স্বামী প্রতিমাসে আশা করে আসতো সেই বিশেষ সময়টি সে চিহ্নিত করতে পারবে। তখনো আমরা জানতাম না আমার উৎপাদিত ডিমের সংখ্যা সীমিত। প্রতিমাসে ব্যাপারটা ঘটে না। আর তাই প্রতি মাসে এক বুক আশা নিয়ে ও ১৪ হাজার মাইল পাড়ি দিত। সপ্তাহ দুয়েক আমার সাথে থাকত, তারপর ফিরে যেত ওর ব্যবসার জায়গায়। একটানা থাকার কারণে কখনোই আমরা সেই বিশেষ সময়টি চিন্হিত করতে পারতাম না। কিন্তু আমাদের বিয়ের মাস তিনেক পরে কর দেবার কারণে মাত্র সাত দিন থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষে ওকে ফেরৎ যেতে হয়। এবার দুসপ্তাহ কাটিয়ে আবার এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ও ফেরৎ আসে। এক বিকেলে আমরা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। হঠাৎ করে কি কারনে ও আমার হাত ধরল, তারপর চমকে বলে উঠলো, “তোমার গা তো দেখি বেশ গরম, জ্বর টর হলো নাকি আবার?”

(৬)

আমার সচরাচর জ্বর হয় না, কিন্তু যখন হয় তখন গা কাঁপিয়ে শীত লাগে। যেহেতু কোনো উপসর্গ নেই, আমি ওকে বললাম এটা জ্বর না । আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম যেন রাত্রি পর্যন্ত আমার এই উর্বরা অবস্থা থাকে। কারন আমার শাশুড়ির সামনে স্বামীকে নিয়ে কোন ভাবেই আমি তখন দরজা বন্ধ করতে পারছিলাম না। সব প্রতীক্ষার ই শেষ হয় ,এটাও হল। শুরু হলো সাঁতার প্রতিযোগিতা।ব্রজেন দাস কত দ্রুত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন আমি জানিনা, তবে আমার শরীরের ভিতরে সেই রাত্রিতে আমার ই এক অনাগত সন্তান, তারা সব ভাই-বোনকে হারিয়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে আমার হঠাৎ পাওয়া সেই ডিমটিকে নিষিক্ত করতে।

(৭)

আমি অবশ্য তখনও এসবের কিছুই টের পাইনি। আমি টের পেলাম বেশ অনেকদিন পরে। আমার স্বামী তখন আমেরিকা ফেরৎ গেছে। হঠাৎ করে আমার ভীষণ ঘুম বেড়ে গেল। সকালে কিছুতেই ঘুম ভেঙে উঠতে ইচ্ছে করেনা। এমনই এক অলস সকালে নাস্তা খেতে বসেছি শাশুড়ির সাথে। হঠাৎ করে নাস্তার দিকে তাকিয়ে আমার গা গুলোতে শুরু করলো, অতঃপর বমি।এমন কুৎসিত একটা ব্যাপার দেখে কোন মানুষ যে এতটা খুশি হতে পারে তা আমার শাশুড়িকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। আমার শাশুড়ি তখনই ছুটলেন আচার রোদে দিতে। হঠাৎ করে এক নিমিষে আমি বাসার সবার থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। সে বড় সুখের একসময়।

(৮)

কিন্তু এই পৃথিবীতে নিরবিচ্ছিন্ন সুখ বলে আসলে কিছু নেই। আর তাই যেমন একদিন হঠাৎ করেই ছোট্ট চিনা বাদামের মত ভ্রুণটি জায়গা করে নিয়েছিল আমার জঠরে,তেমনি নিঃশব্দে আমাকে বিষন্নতার সাগরে ডুবিয়ে একদিন সে আমাকে ত্যাগ করে চলে গেল।

(৯)

ধানমন্ডি থেকে বারিধারার আমেরিকান এম্বাসি বেশ অনেকটাই পথ। আমাকে প্রায়ই সে পথ পাড়ি দিতে হতো সিএনজিতে। পথের সেই ঝাকুনিতে কখন যে আমার সোনামনি টা আমাকে ত্যাগ করে চলে গেল আমি টের ও পাইনি। ওর কি তখন খুব কষ্ট হয়েছিল? আমি জানতেই পারিনি। আসলে আমার অবাধ্যতার কারণে এটা হয়েছে। আমার স্বামী আমার জন্য একটি গাড়ি কিনে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু যেহেতু আমার শাশুড়ি রিকশায় চলাফেরা করেন, তাই আমি গাড়ি নিতে রাজি হইনি। এটা আমার জীবনে একটা অনেক বড় ভুল ছিল, যার মাশুল আমাকে দিতে হয়েছিল বেশ চড়া দামে।

(১০)

আসলে পৃথিবীতে কোনো ভুলই ভুল না, সবই হচ্ছে এক একটি অভিজ্ঞতা। গর্ভপাতের ব্যাপার টা ঘটে ছিলো বলেই আজকে ডাঃ কে বলতে পারলাম কোনো এক সময়ে আমি গর্ভবতী হয়ে ছিলাম। সুতরাং আমি বন্ধ্যা নই। তবে ডাক্তার আমাকে যা বলল তা মোটেই আমার ভেতরে কোন আশার সঞ্চার করতে পারল না।

(১১)

এদেশের ডাক্তারদের এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে । চিনির প্রলেপ দেয়ার কোনো ব্যাপার এখানে নেই । বড়ি যদি তিতা হয় তবে সেই তিতকুটে বড়িই ওরা আপনাকে খাওয়াবে । আমার সামনে বসা ডাক্তার ভদ্রলোক ও তার কথায় কোন চিনির মিষ্টি প্রলেপ দিলেন না। তিনি বললেন ,”যেহেতু অতীতে আপনি গর্ভবতী হয়েছেন, সুতরাং আপনি পুরোপুরি বন্ধ্যা নন। তবে খুব সম্ভবত আপনার উৎপাদিত ডিমের সবগুলো আপনি ব্যবহার করে ফেলেছেন। এমনও হতে পারে এর সিংহাংশ আপনি উৎপাদন করেছেন আপনার স্বামীর সাথে বিবাহের আগে। ভবিষ্যতে আপনি আবারো উৎপাদন করবেন এর সম্ভাবনা কম, তবে একেবারে শূন্য নয়। এখন আপনি কি সেই প্রতীক্ষা করবেন নাকি উন্নত চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে কৃত্তিম উপায়ে গর্ভবতী হবার চেষ্টা করবেন, তা আপনারা স্বামী-স্ত্রী মিলে আলোচনা করে আমাকে জানাবেন। আপনারা এ ব্যাপারে মন ঠিক করলে আমরা আশা করছি আপনাদের সাহায্য করতে পারব।”

(১২)

আমি একরকম ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসছিলাম, তখন একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। দেখি সামনের লবীতে একটি গর্ভবতী মেয়ে ভীষণ চেঁচামেচি করছে। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসলো মেয়েটির স্বাস্থ্য বীমা না থাকায় ডাক্তার তাকে দেখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সে অবশ্য অন্য ডাক্তারের কাছে এসেছে। তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে তার বাচ্চাটিকে নষ্ট করতে চায়। এখানে একই বিল্ডিং এ বেশ অনেকগুলো ডাক্তার বসে। আমার কাছে মেয়েটিকে কিঞ্চিৎ নেশাগ্রস্ত মনে হল।

(১৩)

একজন নেশাগ্রস্ত মানুষের নেশা কাটানোর জন্য কফির চাইতে ভাল কোন পানীয় আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি একটুও চিন্তা না করে মেয়েটিকে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ করলাম। মেয়েটি রাজি হচ্ছিল না, তখন আমি তাকে একটি অকাট্য যুক্তি দিলাম। আমি বললাম,”এই যে তুমি হইচই করছো, ওরা কিন্তু পুলিশ ডাকবে, পুলিশ এসে তোমাকে এই অবস্থায় পেলে কি হবে তুমি জানো। তুমি কি এই অবস্থায় আজ রাতটা পুলিশ স্টেশনে কাটাতে চাও?”

(১৪)

পুলিশের কথায় কাজ হলো। লক্ষী মেয়ের মত সে আমাকে অনুসরণ করল। একগাদা সিঁড়ি ভেঙে আমরা যখন একতলার বিশাল লবিটিতে এসে পৌঁছলাম তখন মধ্যদুপুর। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আমি মেয়েটিকে কফির সাথে একটি স্যান্ডউইচ কিনে দিলাম।স্যান্ডউইচ কেনার কারণ হলো আমি মেয়েটার সাথে কিছু সময় কাটাতে চাই। গর্ভবতী হবার কারণে কিনা জানিনা কিংবা মধ্যদুপুর হবার কারণে মেয়েটি যথেষ্ট ক্ষুধার্থ ছিল। সে এত দ্রুততার সাথে স্যান্ডউইচ খেতে শুরু করল, যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম আমার যা বলবার তা আমি বলার সময় পাবো না।

(১৫)

আমি মেয়েটিকে বললাম,”তুমি যে কত ভাগ্যবান তুমি ধারনাই করতে পারবে না। আমি গত ৭ বছর ধরে গর্ভবতী হবার চেষ্টা করে আসছি। আজ ও সফল হতে পারলাম না। সেখানে তুমি একটি শিশুকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছো। এটা তোমার অধিকার, তুমি করতেই পারো। কিন্তু এমনকি করা যায়না, শিশুটিকে এই পৃথিবীতে এনে এমন কাউকে দাও যার একটি শিশুর খুব প্রয়োজন? এখানে আমার টেলিফোন নাম্বার রইল। তুমি যে কোন সাহায্যের জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারো।শিশুটিকে এই পৃথিবীতে আনার ব্যাপারে আমি সব ধরনের সাহায্য করবো।”

(১৬)

এরপরে বেশ অনেকদিন পার হয়ে গিয়েছে। আমি একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম সেই হতভাগ্য মেয়েটির কথা। হঠাৎ করে এক শীতের সকালে ঘুম ভাঙলো মেয়েটির টেলিফোনে।”তুমি বহুদিন আগে ডাক্তারের চেম্বারে আমাকে তোমার ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলে কোনো দরকার হলে তোমাকে ফোন করতে। আমার তোমাকে ভীষণ দরকার তুমি কি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে?”

(১৭)

মেয়েটির থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম তখন রোদ বেশ চড়া হতে শুরু করেছে। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসলো সে বিরাট একটি আইনি ঝামেলায় পড়েছে। আজ সকালে সে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু শিশুটির রক্তে ড্রাগের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।এই দেশে এই ধরনের শিশুদের ভাগ্য নির্ধারণ করে যে দপ্তর তার নাম চাইল্ড প্রটেক্টিভ সার্ভিস। তারা শিশুটিকে মেয়েটির থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। তবে মেয়েটি যদি তার শিশুটির অধিকার তার পরিচিত কাউকে লিখে দিতে পারে, তবে শিশুটি মেয়েটির জীবন থেকে হারিয়ে যাবে না। ৫ বছর পর মেয়েটি শিশুটিকে ফেরত পাবার আরো একটি সুযোগ পাবে। এই পাঁচ বছর তাকে একটি স্থায়ী জায়গায় থাকতে হবে, বেকার থাকলে চলবে না, স্থায়ী একটা চাকরি থাকতে হবে, এবং নেশা থেকে দূরে থাকতে হবে। এই শর্তগুলো যদি সে পূরণ করতে পারে, তবে সে শিশুটিকে ফিরে পাবার জন্য একজন উকিল নিয়োগ করতে পারবে।

(১৮)

বাংলায় একটা প্রচলিত বাক্য রয়েছে, সাত মন ঘিও পুড়বে না ,রাধাও নাচবে না।আমার কখনোই মনে হয়নি মেয়েটি এই সব শর্ত পূরণ করতে পারবে।সুতরাং আমি নিশ্চিন্ত মনে পড়ে এই মেয়েটিকে নিয়ে আমার ঘরকন্যা শুরু করলাম। আমার পেটে বিবাহিত জীবনের একটি অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। আপনারা কি কখনো কাউকে নারকেল কোরাতে দেখেছেন? প্রথমে অল্প একটু সাদা নারকেল কুলোয় পড়ে, তারপর কখন যেন তা পাহাড় সমান উঁচু হয়ে যায়? আমার মনেরও সেই অবস্থা হয়েছিল বিয়ের পর পর। যদিও আমার স্বামী কখনোই আমাকে লজ্জা দেয়নি,কিন্তু আমি জানতাম আমার ওকে পুরো ব্যাপারটি জানানো উচিৎ ছিল এবং তা বিয়ের আগেই। যেন সে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে, কিন্তু আমি তাকে সে সুযোগ দেয়নি। তাকে আমার সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছিলাম।এই প্রথম দুজন মিলে ভীষণ আনন্দে দিন কাটাতে থাকলাম। একটি শিশুকে চোখের সামনে বড় হতে দেখা সেটা যে কি আনন্দের, যার এই অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি সে ভাবতেই পারবে না। প্রথম যখন শিশুটি হাসতে শুরু করে, বেশি হাসবার কারণে প্রথম যখন বিষম খায়, ছয় মাস বয়সে প্রথম যখন বসতে শেখে, বসতে বসতে হঠাৎ টুপ করে পড়ে যায়, বছরখানেক বয়সে প্রথম যখন কিছু ধরে দাঁড়াতে শুরু করে, তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শুরু করে, মা থেকে বাবা ,বাবা থেকে মা। ওহ সে কি আনন্দ ,আমি আপনাদের ভাষায় বর্ণনা করতে পারবোনা।

(১৯)

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমি আপনাদের আগেই বলেছি, এই পৃথিবীতে নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ বলে আসলে কিছু নেই। এই ঘটনার বছর পাঁচেক পরের কথা।শিশুটিকে আমরা কোন স্কুলে দিব তাই নিয়ে আলোচনা করছিলাম নাস্তার টেবিলে। হঠাৎ কর্কশ শব্দে ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে ভারী কন্ঠস্বর কেউ একজন জানালো, সে এই শিশুটির মায়ের উকিল। তার মা গত পাঁচ বছরে চাইল্ড প্রটেক্টিভ সার্ভিসের দেয়া সব শর্ত পূরণ করেছে। তারা শিশুটিকে ফেরৎ নিয়ে মায়ের কাছে স্থানান্তরিত করতে চায়।

(২০)

ভেনেসা কে ওরা যখন নিয়ে যাচ্ছিল, আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার হৃৎপিণ্ডটা টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমনিতে ও যথেষ্ট শান্ত। কিন্তু এই প্রথম আমি ওর জেদি রূপ দেখলাম।ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না কেনো ওর পরিচিত পরিবেশ থেকে অপরিচিত কিছু মানুষ ওকে নিয়ে যাচ্ছে। ও চিৎকার করে বলতে থাকলো,”আই ওয়ান্ট মাই মামি , আই ওয়ান্ট মাই মামি।”কিন্তু সেই নিষ্পাপ মেয়েটির কথা কেউ শুনল না। আইনের চোখে যে একটি কালো পট্টি বাঁধা থাকে, তার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। আইন আসলেই অন্ধ,সে দেখতে পেল না আমি আর আমার স্বামী কি তীব্র ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলাম এই শিশুটিকে। ভেনেসা যখন ছোট ছিল, অল্প বিস্তর বুদ্ধি হয়েছে, কিন্তু তখনও কথা বলতে শেখেনি, তখন ওর বাবা অফিসে যাবার জন্য যখন প্যান্টের বেল্ট বাঁধতো, তখন বাকলেস এর সেই ঝুনঝুন শব্দ শুনে আমার মেয়েটা কাঁদতে শুরু করতো। আজকে ভেনেসার চলে যাওয়া দেখে ওর বাবাও দাপিয়ে দাপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

(২১)

এদেশে একটা কথা আমি প্রায়ই শুনতে পাই। “Time is a big healer.”যত দিন যাচ্ছে ততই বিষণ্নতা আমায় পেয়ে বসল। আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে কাটাই। এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে আমার স্বামী আমার কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর এসেছে কিনা। ও বলল “তোমার গা তো বেশ গরম। জ্বর আসছে নাকি?” আমি বললাম ,”না জ্বর না।”

এই প্রথম বহুদিন পরে আমরা দুজনে একসাথে হেসে উঠলাম।আমাদের দুজনেরই বহু বছর আগের সেই সুখের স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

(২২)

এদেশে আরো একটা কথা বেশ প্রচলিত।”history repeats itself.”ইতিহাসে একই ঘটনা কিন্তু ঘুরে ফিরে বারবার ঘটে।আমরা দুজনেও আজ বহু বছর পরে আবার মেতে উঠলাম সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। আমার শরীরের প্রতিটি কোষ প্রতিটি রক্তবিন্দু উত্তেজনায় ঝন ঝন করতে থাকলো। যদিও আমি জানি পুরোটাই পন্ডশ্রম।কারন আমার ডাক্তার আমাকে বলেছে আমি আমার সব কটা উৎপাদিত ডিম ইতোমধ্যে ব্যবহার করে ফেলেছি। কিন্তু ডাক্তারের চাইতে বড় কেউ একজন রয়েছেন, যিনি সবজান্তা। তিনি এ কথা স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেছেন,”আমি যা জানি, তোমরা তো জানো না।”আর তাই আমি জানতাম না, আমার আরও লক্ষকোটি অনাগত সন্তানেরা প্রবল বেগে ধেয়ে চলেছে আমার এই জীবনে উৎপাদিত শেষ ডিম টিকে নিষিক্ত করতে।

(২২)

আপনারা কি সে কথাটি শুনেছেন,”every action has a reaction.”? আমাদের এই সান্ধ্যকালীন বিশেষ অ্যাকশন এর কারণে যে রিএকশন টি হবে তার নাম, acrosome reaction.আমার ডিমটি এত লক্ষ কোটি শুক্রাণুর মাঝে কেবল একটি শুক্রাণুকে ভিতরে ঢুকতে দেবে।এবং ঢোকামাত্র আলিবাবা চল্লিশ চোরের সে আরব্য রজনীর গল্পের মতো চিচিং বন।হাজার চেষ্টাতেও আর কেউ সে দেয়াল ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। আমি অবশ্য তখনও এসবের কিছুই জানিনা।

(২৩)

মাসখানেক পরের কথা। আমার স্বামীকে নাস্তা বানিয়ে দিতে উঠেছি। আমি যখন নাস্তা বানাচ্ছিলাম, ও তখন বেল্টের বাকলস লাগাচ্ছিল। বাকলসের সেই ঝুনঝুন শব্দে আমারও তখন ভেনাসের মত ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। খুব ইচ্ছা করছিল বলি আজকে অফিস যেওনা। কিন্তু মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার অনেক কষ্ট। অধিকাংশ সময়ই আমরা যা করতে চাই তা করতে পারিনা।নাস্তার টেবিলে বসে আমার হঠাৎ করে গা গুলিয়ে বমি আসতে শুরু করলো। মনে হলো বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো না।বহু বছর আগে আমার শ্বাশুড়ি খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন আমার বমি দেখে, আজ প্রায় এক দশক পরে আমিও এই শারীরিক কুৎসিত প্রক্রিয়াতে আবারো ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেলাম। বেশ লজ্জা নিয়ে আমার স্বামীকে বললাম,” তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে?”
“বলো।”
“তুমি কি অফিস থেকে ফেরার সময় একটা প্রেগনেন্সি কিট নিয়ে ফিরতে পারবে?”
‘কি বলো তুমি, এত বড় একটা খবর হতে চলেছে , আর আমি অফিস যাব?”
“আমি কিন্তু ঠিক শিওর না, ফলস এলার্ম ও হতে পারে।”
“We will take our chances.”

(২৪)

আমার স্বামী যখন গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করার সে বিশেষ যন্ত্র নিয়ে বাসায় ফিরলেন তখন মধ্যদুপুর। একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছি, আমার জীবনের সব বড় ব্যাপার গুলো দুপুর বেলাতেই হয়। আমরা যখন থার্মোমিটার এর মত দেখতে এই বিশেষ যন্ত্রটির ইন্ডিকেটর এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম তখন বেলা দ্বিপ্রহর।

আমার সবচাইতে অপছন্দের রং হল গোলাপি। অন্য শ্যামলা মেয়েদের বেলায় হয় কিনা জানিনা, যখনই আমি পিংক রংয়ের কোন কাপড় পড়ি, তখনই কোন রকম কার্যকারণ ছাড়া আমাকে ভীষণ বাজে দেখায়। কিন্তু এখন পছন্দ করি বা না করি, আমি চাই ইনডিকেটরের দাগগুলি যেন আস্তে আস্তে গোলাপী হয়ে যায়। কেবলমাত্র গোলাপি দাগ আমার গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করবে।

(২৫)

এদেশে আর একটা কথা বেশ প্রচলিত,”watched pot never boils.”কথাটায় কিঞ্চিৎ সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে।আমি শ্যেন দৃষ্টিতে সেই দাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলেই কিনা জানিনা, দীর্ঘ সময় এদের রঙের কোনো হেরফের হলো না।তারপর হঠাৎ করেই যেন একটু গোলাপী আভা দেখতে পেলাম। গোলাপি রঙের কিছু আমার কাছে এমন সুন্দর আর কখনো লাগেনি। যদিও আমি খুব ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার দু’চোখ তখন ঝাপসা হয়ে গেছে আনন্দ অশ্রু তে।

-শাহাদুল চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *