বোকা মেয়ের গল্প ( ৪র্থ পর্ব)

কেকা এবার চিৎকার করে বলে – না, তারা তো আসে নি।
মায়া বেগমের যেন কথাটা কানে যায় না, তিনি বলতেই থাকেন – আমরা বাসায় নাই, আর তোমার আত্মাীয় স্বজন সব এসে এখানে বেড়ায়, এইটা কেমন কথা? তারা চুরি কইরা বেড়াইতে আসে।

কেকা যতই নিজের পক্ষে যুক্তি দেখাতে চায়, তার কন্ঠ অন্যদের উচ্চ স্বরের নীচে চাপা পড়ে যায়। কেকা বুঝতে পারে না, এদের সমস্যা কি?
বাড়ির বউয়ের আত্মীয় স্বজনরা কি তাকে দেখতে আসতে পারে না? আর যেখানে তারা আসেই নি সেখানে এই মিথ্যা অপবাদ দেওয়া কেন? এ কেমন নিচু মানসিকতা!

কিন্তু এই প্রশ্ন তাদের আর করবে কে? তারা নিজেদের মতোই চিৎকার করে যায়, কেকার কথা শুনবে এমন ইচ্ছাও বোধ হয় তাদের নেই। তাদের শুধু কেকাকে নানান ভাবে অপমানিত করাই হলো উদ্দেশ্য। কেকা নিজের কথা বলতে চেয়ে বলতে পারে না,তার চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয় তখন কেকা অসহায় ভাবে মাথা নিচু করে, চোখ থেকে এখন আর কান্না ঝরে না। কারণ এদের সামনে কান্না করারও কোন অর্থ নেই এরা কেকাকে কাঁদতে দেখলে আনন্দিত হয়। তাই অহেতুকই এরা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে আনন্দ পায়।
কিন্তু ঘটনা ছিলো ঠিক এর উল্টো । মায়া বেগম আর রফিক সাহেব দেশের বাড়ি গিয়েছিলেন বেশ কিছুদিনের জন্য। বাসায় তখন কেউ ছিলো না। তাহমিনাকেও তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো তার চাচা।
শিপার মামা শ্বশুুর বরাবরই কেকাকে বেশ স্নেহ করেন, তিনি তার বড় ছেলের বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছিলেন। নাস্তা করে কার্ডটি কেকার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে যখন শিপার মামা শ্বশুুর ফিরে যাচ্ছিলেন, পাশের বাসার বৃদ্ধা আমিনা বেগমও তখন দরজা খুলেছিলেন। কেকা তার সাথে মামাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মামা বলে। তার কাছ থেকেই মায়া বেগম শুনেছেন হয়তো কথাটা, আর তাই নিয়েই আজকের শালিস। অথচ কেকা শিপার মামা শ্বশুরের দেওয়া বিয়ের কার্ডটা মায়া বেগম বাসায় ফিরে আাসার সাথে সাথেই তার হাতে তুলে দিয়েছে এবং তার আসার কথাও বলেছে। তবুও তারা আজকে দোষারোপ করছে – কেকার মামা না কি তাদের অবর্তমানে এখানে বেড়াতে এসেছে।
কিছুতেই তারা কেকার কথা শুনতে চাচ্ছে না, নতুন বউ হয়ে আসা কেকা ধীরে ধীরে নিজের কণ্ঠ উঁচুতে তুলতে শিখছে, যে নিজের পরিবারে কখনও উঁচু গলায় কথা বলেনি সে আজ নিজের স্বপক্ষে কথা বলার জন্য আপ্রান কন্ঠ উঁচুতে তুলে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু সবার কন্ঠের নিচে ক্রমশই তার কন্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে।
কেকার দুনিয়াটা দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে, যেভাবে কেকা এতদিন চিন্তা করে এসেছিলো সেই চিন্তা গুলোকে ক্রমশই তার ভুল মনে হচ্ছে, কেকা শিখে যাচ্ছে নিজের কথা নিজেকেই বলতে হয়।গলা উঁচু করতে হয়, তোমার পাশে কেউ দাঁড়াবে না যদি তুমি নিজে নিজেকে রক্ষা করতে না পারো। কেকার এতদিনে শিক্ষা এখন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, বদলাচ্ছে কেকাও।
এত সমান্য একটা বিষয় নিয়েও যে কেকার এত জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে সেকথা কেকা কখনও কল্পনাও করতে পারে নি। যদি বাড়ির বউয়ের আত্মীয় স্বজন তাকে তার শ্বশুর শাশুড়ির অবর্তমানে দেখতেও আসে তাহলে তো দোষের কিছু নেই।
কিন্তু কেকা আজ এই কারণেই দোষী , অথচ কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
একটা মেয়ে তার আপনজন সবাইকে ছেড়ে নতুন একটা সংসারে যখন আসে তখন সে থাকে সম্পূর্ণই একটা শিশুর মতো, তাকে যদি ভালোবাসা দেওয়া হয় তাহলেই সে উল্টো ভালোবাসতে শিখবে, অথচ প্রতিটি পদক্ষেপে যদি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তুমি আমাদের কেউ নও, তুমি আলাদা, তোমার অতীতের কোন মূল্য নেই আমাদের কাছে, তখন কী করে একটা মেয়ে একটা সংসারকে আপন করে নিবে?
এত প্রতিকূলতার মাঝে ক্রমশই কি সে এই নতুন পরিবার থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয় না?কেকারা হয়তো এভাবেই দূরে সরে যায়।

সামনে অনার্স পরীক্ষা আর সেই সাথে কেকার শরীরের অবস্থা দিনকে দিন ভারী হতে থাকে, এত কিছুর সাথে চলতে থাকা প্রতি মুহূর্তে মানসিক অত্যাচার কেকাকে যেন আস্তে আস্তে নিজের ভিতর লুকিয়ে যেতে বাধ্য করছে, কেকা হাসতে ভুলে যাচ্ছে, কথা বলতে ভুলে যাচ্ছে।

একদিন যথারীতি খাবার টেবিলে ডাক পরলো কেকার। আজ গরুর মাংসটা কেকাই রেধেছিলো শখ করে। খাবার টেবিলে বসে মায়া বেগমের যথারীতি তারস্বরে চিৎকার শুনে কেকা যেন তাহমিনার মতোই মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ালো খাবার টেবিলের পাশে – এই মাংসে কী মসলা দিছো তুমি, মাংস খাইতে এমন হইছে কেন?কেকা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো – মা, আপনারা তো মাংসে জিরা বাটা খান না, আমি আজকে জিরা বাটা দিয়ে মাংস রান্না করেছি।মায়া বেগম এবার গর্জে উঠলেন – তোমারে কে কইছে মাংসে জিরা বাটা দিতে? মাংসে জিরা বাটা দিলে খাইতে কেমন আচার আচার লাগে, খবর্দার এর পর আর জিরা বাটা দিয়া মাংস রানবা না।

কেকা কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলে না, ঠিক এই মুহূর্তে কেকার আর এই বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
সারাজীবন কেকা দেখে এসেছে গরুর মাংসে জিরা বাটা দিয়ে তার মাকে মাংস রান্না করতে কিন্তু এখানে এসে দেখে ভিন্ন চিত্র। কেকা জানে এক অঞ্চলেের সাথে অন্য অঞ্চচলের রান্না বান্না সব কিছুতেই পার্থক্য থাকবেই কিন্তু এখানে যেন সব কিছুতেই ব্যতিক্রম। কেকার আজ আর কথা বলতে রুচি হলো না, চুপচাপ শুধু শুনে গেলো।

এই ঘটনার বেশ কিছু দিন বাদে মায়া বেগম শিপার বাসায় বেড়াতে যান, সেখান থেকে ফিরে এসে কেকাকে ডেকে বলেন – শোন কেকা, গরুর মাংস রান্না করার সময় সাথে একটু জিরার বাটাও দিও, তাইলে মাংস আরও মজা হয়, শিপার বাসায় দেখলাম ওর শাশুড়ি জিরা বাটা দিয়া মাংস রানছে, কিযে মজা হইছে!

কেকা অবাক হয়!-তাই মা? কিন্তু আপনি যে এতদিন বলছেন জিরা বাটা দিলে আপনার কাছে আচারের গন্ধ লাগে?

মায়া বেগম ইতস্তত করে বলেন – কবে কইলাম তোমারে? কোথায়? আমার তো মনে নাই।

কেকার দিন যায় এভাবেই, প্রতি মুহূর্তে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। এরই মাঝে কেকার ভিতরের অনাগত সন্তান দিনকে দিন বেড়ে ওঠে, কেকা তার নিজের ভিতরে একান্ত আপন একজনের তিলে তিলে বেড়ে ওঠা অনুভব করতে থাকে, যখন কেকার গর্ভস্থ সন্তান সাত মাসে পা দেয় হঠাতই কেকার শরীরটা খারাপ করে, ডাক্তারের কাছে গেলে কেকাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেন তিনি। বাচ্চার পজিশন ভালো না তাই বেশ কিছুদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে বলেন, আরও বলেন পায়ের নীচে বালিশ দিয়ে শুতে। এই মুহূর্তে বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ আছে বলে ডাক্তার জানান।
এই কথা শুনে মায়া বেগমের বড্ড হাসি পায়। তার চেয়েও আরও বেশি হাসি পায় সেই একই ডাক্তার আবার নয় মাসের সময় যখন কেকাকে পরামর্শ দেন – প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করতে, তাহলে বাচ্চার নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এই পর্যায়ে মায়া বেগম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না – মুখ বাকিয়ে বেশ একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলেন – সে কী! এই শুনি বাচ্চা পইররা যাইবো শুইয়া থাকতে কয়, আবার এই শুনি হাটন লাগবো,নইলে বাচ্চা বাইর হইবো না। আমাগো সময় তো এত কিছু শুনি নাই, আমাগো কী আর বাচ্চা হয় নাই? কালে কালে কতো ঢং যে দেখমু!!
হয়তো সময়ের সাথে সাথে মায়া বেগমরা নিজের মুখের বলা কথা গুলো ভুলে যান, কিন্তু কেকারা কি তা সহজে ভোলে? ভোলে না, ভোলা হয়তো সহজ না।

গত তিনদিন ধরেই কেকার শরীরটা ততো ভালো না, পেটে ব্যথা করছে ক্রমাগত, ওদিকে কেকার দেবর রিপন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। তাকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত, কেকা সজলকে বেশ কয়েকবার বললো – আমার অবস্থা কিন্তু ভালো লাগছে না, যদিও ডাক্তার বলেছে আরও ১৫ দিন বাকী কিন্তু আমার কেমন জানি খারাপ লাগছে, আমাকে না হয় বাবার বাসাতেই পাঠিয়ে দাও। নইলে আব্বাকে আসতে বলো, তাকে নিয়েই আমি ডাক্তারের কাছে যাই।
সজল কিছুতেই কেকার কথায় রাজি হয় না, তার এক কথা- তোমাদের বাসা শহর থেকে দূরে, হঠাৎ দরকার পরলে ডাক্তারের কাছে আসতে আসতেই কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তার চেয়ে এখানেই থাকো। দু একদিন যাক আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। কেকার আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না।

আজ কেকার অবস্থা আরও খারাপ, মায়া বেগম বিকেলেই রিপনকে নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। মাঝ রাতে কেকার পেটের ব্যথা বাড়তে থাকলো, সজলেরও এসব বিষয়ে তেমন কোন ধারণা নেই, তাই বললো – যাও তো মাকে গিয়ে বলো, তোমার এই অবস্থার কথা।
কেকা মায়া বেগমের কাছ সব কথা খুলে বললে তিনি বললেন – কিছু হয় নাই, সন্ধ্যা বেলা কাঠাঁল খাইছো তো তাই এমন হইতাছে, যাও গিয়া ঘুমাইয়া থাকো।
সারারাত কেকার থেমে থেমে ব্যথা উঠছে, সজল কেকার পাশে সারারাত ঘুমহীন জেগে থাকলো, ডাক্তারকে ফোন করতে তিনি বললেন – সকালেই চলে আসুন।
সকাল ৯টার দিকে কেকাকে ডেলিভারি রুমে নেওয়া হলো, ব্যথায় কেকা নীল হয়ে যাচ্ছিলো, তবু সে ভয়ে শাশুড়ির সামনে একটা উহ! শব্দও করলো না।
খবর পেয়ে কেকার বাবা মা ছুটে এলেন।। ডেলিভারি রুমে নেওয়ার আগ মুহূর্তে কেকার বাবা এসে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন, কেকা নিজেকে তখন আর সামলাতে পারলো না, বাবাকে দেখেই হয়তো তার সব ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলো, বাচ্চা মেয়ের মতো কেকা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মেয়ের সাথে সাথে কেকার বাবারও চোখ দুটো ছলছল করে উঠছে,তিনি আদর করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কি যেন বলতে গেলেন কিন্তু কোন কথা বলার আগেই কেকাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। কেকা যেতে যেতে তাকিয়ে দেখলো তার বাবা মা অসহায় ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে ছলছল চোখে।

ডাক্তার রুমে এসে কেকাকে পরীক্ষা করেই বললেন – সেকি, বাচ্চার তো খুব খারাপ অবস্থা। আরও দুদিন আগেই ডেলিভারি করানোর দরকার ছিলো। বাচ্চাকে বাঁচানোই তো এখন কঠিন হয়ে যাবে।
সেই মুহূর্তে কেকার মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না যেন, সে একমনে সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করছিলো শিশুটিকে সুস্থ অবস্থায় দেখার জন্য।একবার দুহাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে কেকা সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে চলছিলো একাগ্রচিত্তে!

ডাক্তার তার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন, যখন শিশুটি পৃথিবীতে এলো, কেউ তার সুতীব্র চিৎকার শুনতে পেলো না।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর শিশুটির চিৎকার শুনে কেকা কাঁদতে লাগলো – হ্যা, প্রাণ আছে! প্রাণ আছে! প্রাণ ফিরে পেয়েছে কেকার সন্তান, সে বেঁচে আছে।
কেকার বুকের কাছে তার নিজের সন্তান, মাতৃত্বের আনন্দ তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে সমস্ত যন্ত্রণা!সন্তান ভূমিষ্ঠ করার কষ্ট!
সন্তানের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত মা ই হয়তো ভুলে যান মাতৃত্বের অসহ্য যন্ত্রণার কথা!

কেকার ছেলে হয়েছে। কেকা তার ছোট্ট কপালে চুমু দিলো অদ্ভুত এক ভালোলাগা নিয়ে ! কী এক অপার্থিব মায়ায় আচ্ছন্ন হলো সে!
নার্স এসে কেকার ছেলেকে বাইরে নিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর সজল রুমে প্রবেশ করলো, কেকার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে সে।কেকা সজলের কোলে শিশুটিকে দেখতে না পেয়ে বললো,তুমি দেখেছো ওকে? কার কাছে রেখে এসেছো ওকে?

হ্যা দেখেছি। ওকে এখন ওর দাদা দাদু, নানা নানু সবাই ঘিরে আছে। আমি তাই তোমার কাছে এলাম ওর পাশে তো সবাই আছে, তোমার কাছে তো কেউ নেই। আমি না হয় কিছুক্ষণ তোমার কাছেই থাকি!সজলের দুচোখ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে আনন্দের হাসি, বাবা হওয়ার গর্বের আর আনন্দের হাসি!

কেকার চোখ গড়িয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু, মাতৃত্বের কষ্ট আর আনন্দ মিশ্রিত অশ্রু!

কাঁদছে কেকা। এই সংসারে এত দিনে কেকার একান্ত আপন তো কেউ হলো!!!

-শামীমা হক ঝর্ণা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *