বোকা মেয়ের গল্প ( ৮ম পর্ব )


এবার শুরু হয় মায়া বেগমের তার ছোট ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজা । ছোট ছেলের জন্য মনের মতো বউ খুঁজতে কোমর বেধে নামেন তিনি। বহু খুঁজে পেতে বড় লোক কাকার এক ভাতিজি খুঁজে বের করেন, ঢাকায় তার কাকার বাড়ি গাড়ির অভাব নাই। সুতরাং মায়া বেগম ছোট ছেলের বিয়ে দেন ধুমধাম করেই।
বর যাত্রার আগের দিন মায়া বেগম ছোট ছেলের ঘরের পুরানো ফার্নিচার সব বের করে ঘরটা একদম খালি করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখেন, ছোট বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে খাট পালঙ্ক আসবে সেই আনন্দে খুশি আর তার ধরে না। কিন্তু যখন পাত্রী আসে সাথে তার খালার দেওয়া একটা খাট, মামার দেওয়া একটা ড্রেসিংটেবিল, ফুফুর দোওয়া একটা আলমারি আর ফ্রিজ, আত্মীয় স্বজন সবার মিলে দেওয়া এই সামান্য আসবাবপত্র আর বারো আনার হাতের বালা দেখে মায়া বেগমের মন ভরে না।
কাকার ঢাকার ফ্ল্যাট আর গাড়ি বাড়ি দেখেই যে মেয়েকে বিয়ে করিয়ে আনেন তিনি, সেই মেয়ের বাপের বাড়িতে গিয়ে যখন দেখেন ভাঙ্গা ঘর তখন মায়া বেগমের মুখটা কালো হয়ে যায়।বুকের ভিতরটা বুঝি হাহাকার করে ওঠে।
ছোট ছেলের বউকে কাকার অর্থকড়ি দেখে বউ করে এনেছিলেন মায়া বেগম তাই শিক্ষা নিয়ে ততটা ভাবেন নি মায়া বেগম।
এইচ এইচ সি পরীক্ষা দিয়েছে পাত্রী। বাকী পড়াশুনা মায়া বেগম নিজেই চালিয়ে ছেলের বউকে উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন,এতদিন বেশ জোর দিয়ে বলছিলেন সে কথা কিন্তু যখন রেজাল্ট হলো জানা গেলো বউ এর আগেও তিনবার পরীক্ষায় ফেল করে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে, মায়া বেগমের তখন আফসোসের শেষ রইলে না। কিন্তু পড়াশোনা দিয়ে কী হবে মায়া বেগম?
বাড়ির বউ থালাবাসন ধোয়া আর ড্যাগ খানেক রান্না করতে পারলেই তো পরিপূর্ণ গৃহিণী। আর কী লাগে? বাড়ির বউ পড়াশোনা করে জজ ব্যারিস্টার হলে তার কী লাভ?
বউ খাট্টা রানতে পারে কিনা সেটাই হলো আসল কথা!

বাপের বাড়ি থেকে কি দিলো না দিলো এই নিয়ে মায়া বেগমের সাথে ছোট বউয়ের প্রায়ই বিবাদ বাধে। কেকা এখন সংসার থেকে নিজেকে যতোটা দূরে রাখা যায় ততটাই দূরে থাকতে শিখে গেছে। দায়িত্বপালন রান্না বান্না সব ঠিক রেখে যতোটা পারে সে নিজের মতোই জীবন যাপন করে।
নুডুলস রাধতে গিয়ে ছোটবউ যখন পেয়াজ মরিচ আদা রসুন নিয়ে রাঁধতে যায় কেকা তখন তাকে যত্ন করে রান্নাটা শিখিয়ে দেয়। ছোট ছোট কাজ গুলো কেকা তাকে শেখায় যেন তার মতো করে এই নতুন আসা মেয়েটাকে কষ্ট পেতে না হয়। ছোট এই মেয়েটার ভুল গুলো আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে সে, নইলে যদি আবার তাকে সবাই মিলে কেকার মতোই অপমান করে!

সংসারটা চলে সজলের উপার্জনে। বাসা ভাড়া সংসার খরচ সব মায়া বেগমের হাতে তুলে দেওয়ার পরও বিস্কুট চানাচুর, নাস্তা ফল যখন যা লাগে সজল অফিস থেকে আসার সময় হাতে করে নিয়ে আসে। রফিক সাহেবের জন্য চা রুদ্রর জন্য আনা গুড়া দুধ থেকেই বানায় কেকা। সেখানে আলাদা হিসেব আর করা হয় না।

একদিন শিপার শশুড় বাড়ির সব আত্মীয় স্বজন এসেছে রোজার ইফতারের দাওয়াতে। সারাদিন রোজা রেখে মায়া বেগমের সাথে রান্না বান্না মেহমানদারি করায় ব্যস্ত কেকা। আজান দিলে সবাই ইফতারি করলেও বাড়ির বউদের ইফতারি করার সময় হয় না, কোন মতে একটু শরবত খেয়ে চা বানাতে দৌঁড়ায় কেকা। তাড়াহুড়োয় গুড়া দুধের কৌটোর মুখটা ভালো করে লাগাতে ভুলে যায় সে। যদিও বড় ডানো দুধের টিন থেকে ছোট একটা কৌটোয় আলাদা করে গুড়া দুধ ভরে নিয়ে তবেই ব্যবহার করে কেকা ।
মেহমানদের চা দিচ্ছে যখন কেকা, শিপার শাশুড়ি তখন বারে বারে বলেন – মা তোমরা তো ইফতারি খেলে না, একটু খেয়ে তারপর চা খাও।

কেকা মনে মনে সব সময়ই এই মহিলাকে শ্রদ্ধা করে। বাড়ির বউকে সম্মান দিতে জানেন তিনি। কেকা হেসে বলে – খালাম্মা আপনারা খেয়ে নিন, আমরা পরে খাবো।

শিপার শাশুড়ি তবুও তাড়া দেন – আর কতো পরে খাবে? আজান হলো সেই কখন! খেয়ে নাও।

এরই মধ্যে শোবার ঘর থেকে রুদ্রর ডাক শুনে সেদিকে দৌঁড়ে যায় কেকা, সজল আর ছেলে রুদ্র খাটে বসে বসে টি ভি দেখছিলো, মায়া বেগম তখন হাতে করে গুড়া দুধের কৌটোটা নিয়ে সরাসরি চলে আসেন কেকার শোবার ঘরে, হাতের কৌটোটা উঁচু করে ধরে দোলাতে দোলাতে বলেন- সজলরে দ্যাখ,দ্যাখ তর বউয়ে কী করছে!
মায়া বেগমের কথার সুর শুনেই কেকা বুঝতে পারেন – কাহিনী সুবিধার না!

তাকিয়ে দেখেন গুড়া দুধের ছোট কৌটটা নিয়ে মায়া বেগম দুহাত দিয়ে ঝুলাচ্ছেন আর বলছেন – দ্যাখ, তোর বউয়ে কৌটার মুখ না লাগাইয়াই থুইয়া আইছে। সব গুড়া দুধ এইবার নষ্ট হইবো। কেকা কিছু বলার আগেই মায়া বেগম চিৎকার করতে থাকেন – এই লাট সাহেবের বেটিরে দিয়া সংসার চলবো কেমনে? এমুন করলে সংসার তো লাটে উঠবো।

ঘর ভরা মেহমান তার মধ্যে মায়া বেগমের এমন চিৎকার, কেকা উত্তর দিবে কী? লজ্জায় তার মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে! এই লজ্জা তার নিজের জন্য না, এই লজ্জা মায়া বেগমের সৌজন্য বোধহীনতার জন্য। মায়া বেগমকে চাইলেই কেকা উত্তর দিতে পারে, কিন্তু এত গুলো মেহমানের সামনে গলা উঁচু করে কথা বলতে কেকার রুচিতে বাধছিলো। সারাদিনের রোজা রাখার ধকল আর মেহমানদারি করে ক্লান্ত কেকা এবার ধপ করে বিছানার একপাশে বসে পড়ে বিষণ্ণ হয়ে, কেকার সেই বিষণ্ণতা বুঝি রুদ্রকেও স্পর্শ করে, মায়ের ভিতরে গুমরে ওঠা কান্না কেউ না শুনলেও রুদ্র বুঝি তা শুনতে পায়! সমস্ত ঘটনার মধ্যের অস্বাভাবিকতা এত বড় বড় মানুষ গুলো বুঝতে না পারলেও অবুঝ শিশু রুদ্র যেন তা বুঝতে পারে, আর তাই তো তিন বছরের রুদ্র চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে- আমার আম্মুকে বকেছো তুমি,আমার আম্মুকে বকেছো? কেন? আমার আম্মুকে তুমি বকেছো কেন?
রুদ্রের কান্নায় এমন কিছু ছিলো, এমন কোন অধিকারের জোর, যা মায়া বেগমকে স্তম্ভিত করে দেয়।

রুদ্রর কান্না শুনে মায়া বেগম কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে হয়ে তাকিয়ে রইলেন,নিজের কানকে যেন হঠাৎ করেই বিশ্বাস করতে পারলেন না , মাত্র দুতিন বছরের একটা বাচ্চা যাকে তিনি এতদিন আদর স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন সেই শিশুই যে তার আচরণের এমন প্রতিবাদ করবে এটা বোধ হয় তার কল্পনার বাইরে ছিলো। এই প্রথম মায়া বেগম তার আচরণের তীব্র প্রতিবাদ ক্ষুদ্র একটা মানুষের কাছ থেকে পেয়েও হজম করতে বাধ্য হলেন, এই প্রথম নিঃশব্দে তিনি রণ ক্ষেত্র থেকে পরাজিত সৈনিকের মতো প্রস্থান করলেন।
তবে এই ঘটনার পর থেকে মায়া বেগমের মাঝে কিছু আশ্চর্যজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো, তিনি রুদ্রর সামনে কেকার সাথে দ্বিতীয় বার আর এধরণের আচরণ করার সাহস পেলেন না। নিজের রক্ত বলেই বোধ হয় তিনি ছোট শিশুটিকেও সমঝে চলা শুরু করলেন। পারতো পক্ষে তিনি রুদ্রের সামনে কেকার সাথে আর গলা উচু করে কথা বলার সাহস দেখালেন না।

রুদ্রর জ্বর, বেশ কিছুদিন ধরেই ওর ঘন ঘন জ্বর আসছে। কেকা রুদ্রের মাথায় পানি দিচ্ছে তবু জ্বর কিছুতেই কমছে না। খাওয়া দাওয়াও বন্ধ প্রায়। খবর পেয়ে টুনিও এসেছে। রুদ্রর সাথে মাঝে মাঝে গল্প করছে, ওর খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে মায়া বেগম রুমে এসে দেখে গেছেন বেশ কয়েকবার।
আর কারও জন্য মায়া বেগমের মায়া কম বেশি থাক বা না থাক রুদ্রর জন্য তার প্রচন্ড মায়া , নিজের ছেলের সন্তানকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসেন তাই কিছুক্ষণ পর পরই ছুটে আসছেন রুদ্রর কাছে।
কেকা রুদ্রকে কোলে করে নিয়ে পায়চারি করছে, হাঁটতে হাঁটতেই কেকা যখন ড্রয়িংরুমের দিকে গেলো ঠিক তখন ওখানে বসে থাকা মায়া বেগমকে দেখে রুদ্র মাথা তুলে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলে উঠলো – তুমি পঁচা, তুমি আমার নানা নানুকে এখানে আসতে দাওনা, খালামনিদেরও এই বাসায় আসতে দাও না, তোমার জন্যই তারা এখানে আসে না, তুমি পঁচা। তুমি পঁচা। হঠাৎ করেই রুদ্রের এই আচরণে কেকা এবং মায়া বেগম দুজনেই থমকে তাকালো , এ কী জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে রুদ্র? মূলত মায়া বেগমের কারণে কেকার বোনরা, বাবা- মা, কেউই এই বাড়িতে বেড়াতে আসতেন না, সেকথা ঠিক। কিন্তু কেকা কখনই রুদ্রর সামনে সেসব নিয়ে কথা বলেনি বরং কেকার বরাবরই মনে হয়েছে একটা শিশুর সামনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ঠিক না। তবুও বিষয়টা হয়তো রুদ্র কখনও খেয়াল করেছে অথবা কেকাকে একা একা কাঁদতে দেখে রুদ্র নিজেই বুঝে নিয়েছে সব কিছু।
হঠাৎ করে রুদ্রর মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনে কেকা এবং মায়া বেগম দুজনেই বেশ অবাক হলো, যে কথা কেকা কখনও মুখ ফুটে বলতে চায়নি সেই কথাই রুদ্রর মুখে শুনে কেকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
আর মায়া বেগম?
তার ভিতরটা কি একটু কেঁপে উঠলো, রুদ্রর এই কথায় ?
এতদিনের চিন্তা চেতনার গোড়ায় কি কষাঘাত হলো? মায়া বেগম?
মায়া বেগমের সামনে এতদিন অন্যায় জেনেও কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন কথা বলার সাহস পায়নি। না সজল, না রফিক সাহেব।
যে সংসারটা একদিন মায়া বেগম নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন , যে সংসারে নবাগত একটা পরগাছার মতো কেকারা আশ্রয় খুজে বেড়িয়েছে। আজ কি ক্রমশই সেই সংসারটার ভীতে আঘাত লাগছে মায়া বেগম?
যে মায়া বেগমের কথার উপর এতদিন কেউ কথা বলতে পারেনি সেই মায়া বেগমের সামনেই ছোট্ট একটা শিশু কি নির্ভীক ভাবে কঠিন সত্য গুলো প্রকাশ করছে অবলীলায়! এটাই সংসারের নিয়ম। ক্ষমতা বদলের খেলা সব খানেই চলে, খুব সূক্ষ্ম ভাবে এই খেলা খেলেন সৃষ্টিকর্তা। ক্ষমতা যখন যার কুক্ষিগত থাকে তখন সেকথা ক্ষমতাধররা বোঝেন না, অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করেন।

-শামীমা হক ঝর্ণা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *