ভালোবাসা-৯০

“এই, আপনে প্রতিদিন স্কুলের সামনে দাঁড়ায় থাকেন ক্যান? কী সমস্যা আপনার?”

একটু দূরে লিজার বান্ধবীরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। লিজার এমন মারমুখী চেহারার সাথে তারা পরিচিত না। রাশেদও ভ্যাবাচেকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লিজার মতো শান্ত ভদ্র মেয়ে এমনভাবে তাকে আক্রমণ করতে পারে, সে ধারণা করেনি।

রাশেদ আমতা আমতা করে বলল, “এমনেই দাঁড়ায় থাকি। কোনো সমস্যা নাই।”

“অবশ্যই সমস্যা আছে। আপনে শুধু দাঁড়ায় থাকেন না, আমাকে ডাকাডাকিও করেন। রিকশা নিয়ে আমাকে ফলো করেন। এখন বলেন, কীজন্য ডাকাডাকি করেন? প্রেম ভালোবাসার কথা বলবেন? লাভ লেটার দিবেন?”

রাগে ফুঁসছে লিজা। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। রাশেদের একটু ভয় ভয় লাগছে। তার দুই বন্ধু রনি আর অমিত কখন যেন নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রাস্তার ওপারে একটা বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে রাশেদের দুরবস্থা দেখছে ওরা দুজন।

“না লাভ লেটার ক্যান দিবো, ছি ছি। কিছুই দিবো না।”

“কিছুই দিবেন না, তাহলে প্রতিদিন এখানে বেক্কলের মতো দাঁড়ায় থাকেন ক্যান?

রাশেদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। ও লিজার সাথে কথা বলার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে থাকে, এটা বলা সম্ভব না। সিনেমায় যেমন দেখায়, নায়িকা রেগে নায়কের গালে চড়  দেয়, এই মুহূর্তে তেমন কিছু হলে অবাক হবে না রাশেদ। রাগান্বিত  লিজাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। সবসময় যেমন নরম আর শান্ত মনে হয়, এখন তেমন লাগছে না।

মাসখানেক হলো স্কুল গেটের একটু দূরে শিমুল গাছটার নিচে এই তিনটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম কয়েকদিন তেমন খেয়াল করেনি লিজা। অনেক ছেলেই তো দাঁড়িয়ে থাকে এদিক ওদিক, রাস্তার ওপারে দোকানগুলোর সামনে অনেকেই আড্ডা দেয়, মেয়েদের দেখলে নিচু গলায় নোংরা কথা বলে, খ্যা খ্যা করে হাসে। স্কুল থেকে বেশ কয়েকবার ওই দোকানগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে, এখানে দাঁড়িয়ে ছেলেরা যেন স্কুলের মেয়েদের বিরক্ত না করে। কয়দিন একটু ভালো যায় তো আবার একই অবস্থা। স্কুল ছুটির সময় ছেলেগুলো জটলা বাধাবেই।

রাশেদ অবশ্য প্রথম কয়েকদিন কিছুই করেনি। লিজার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিল, রিকশা  নিয়ে লিজার পেছন পেছন গিয়েছিল। তিন চার দিন পর তার দুই বন্ধু রনি আর অমিত মহাবিরক্ত আর অধৈর্য হয়ে উঠল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এভাবে লাইলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কতদিন পার করবে মজনু। কিছু একটা করার জন্য ভীষণ চাপ দিতে লাগল ওরা।

এই অবস্থায় একদিন লিজাকে পেছন থেকে নিচু গলায় ডাকল রাশেদ।  একটা অচেনা ছেলে তাকে কেন ডাকছে, এই ভেবে লিজা একটু ঘাবড়ে গেল। পেছন ফিরে তাকায়নি, হনহন করে হেঁটে রাস্তা থেকে রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিল। বাসায় এসে মনে হলো, শোনার ভুলও হতে পারে। লিজার নাম ধরে আসলে ডাকেনি ছেলেটা।

পরদিন স্কুলে যাওয়ার পর অবশ্য সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হলো। লিজার বান্ধবী স্নিগ্ধা উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসে বলল, “এই লিজা, ওই কাইল্লা ছেলেটা কালকে তোকে ডাকাডাকি করলো ক্যান?”

লিজার আত্মা কেঁপে উঠল। “কোন ছেলে? আমাকে কেউ ডাকে নাই তো!”

“এহ, বললেই হইল? প্রতিদিন ছেলেটা স্কুলের সামনে তোর জন্য দাঁড়ায় থাকে, তোর পিছে পিছে রিকশা নিয়ে যায়। কালকে তোকে ডাকও দিলো। এখন তুই এমন ভাব করতেছিস য্যান কিছুই জানোস না।”

লিজা কিছু জানার আগের ক্লাসের অর্ধেক মেয়ে জেনে গেল, খ্যাত, কালো, বেটে কুৎসিত একটা ছেলে লিজার জন্য স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছুটির পরে ক্লাসের সবাই বাইরে ছেলেটার দিকে তাকায় আর মুখ চেপে হাসে। ক্লাসে ওই ছেলেকে নিয়ে লিজাকে খোঁচাখুঁচি করতে কেউ কার্পণ্য করে না। লিজার বান্ধবীরা ছেলেটার নাম দিলো “কালো রোমিও”।

কে একজন খোঁজ নিয়ে এলো ছেলেটার নাম রাশেদ, কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। লিজাদের বাসার কাছেই নাকি থাকে। কিন্তু লিজা ভেবেই পায় না ছেলেটা কেন তাকেই টার্গেট করল। স্কুলের সামনে ওমন ক্যাবলার মতো কেনই বা দাঁড়িয়ে থাকে। এর আগে ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের জন্য দুই তিনজনকে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছে লিজা। ও নিজেকে তেমন সুন্দরী মনে করে না। ওর জন্য পাগল হয়ে কেউ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যাবে, ভাবেনি লিজা। তাই বলে এমন একটা ছেলে জুটল ওর ভাগ্যে!

রাশেদ ভয়াবহ কালো, দাঁত একটু উঁচু। বেঁটে , শুকনো শরীরে ঢলঢলে শার্ট এমনভাবে ঝুলতে থাকে যেন কাকতাড়ুয়া ! শার্ট যেমন ঢিলা জিন্সের প্যান্ট তেমন চাপা! চোখে সস্তা সানগ্লাস। ঢেউ খেলানো চুল হাল ফ্যাশনে কাটা হলেও ছেলেটাকে আরও বেখাপ্পা লাগছে।

লিজার অসহ্য লাগে। সালমান বা শাহরুখ খানের মতো দেখতে না হোক, একটু চলনসই ছেলে ওর জন্য স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও চলতো। এমন এলিয়েন ধরনের ছেলে কেন? রাশেদের জন্য বান্ধবীদের টিপ্পনী শুনতে শুনতে সে ত্যক্ত হয়ে গেছে।

আজকে আবার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার খাতা দিয়েছে, লিজা অঙ্কে চুয়ান্ন পেয়েছে। খুব বোকার মতো কিছু ভুল উত্তর দিয়েছিল পরীক্ষার খাতায়।  মেধা তালিকায় এক থেকে দশের মধ্যে লিজা নেই। অথচ ও যথেষ্ট ভালো ছাত্রী। টিচারটা যখন প্রথম দশ জনকে আলাদা করে সামনে ডেকে নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ব্যাপারে অনেক উৎসাহের কথা বললেন, লিজার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল।  শিমলা নামে যে মেয়েটা অষ্টম হয়েছে, আগের পরীক্ষাতেও মেয়েটা লিজার থেকে অনেক কম নাম্বার পেয়েছিল। আর এখন কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। টিচারদের কথা শুনে বোঝা গেল এই দশ জনের কাছ থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় খুব ভালো নাম্বার আশা করছেন তাঁরা। আর বাকিরা কী? লিজাও খুব ভালো ছাত্রী, ও নিশ্চই খুব ভালো করবে অথচ ওকে এখন গোনাতেই ধরছেন না শিক্ষকরা। একসময় খুব রাগ হতে থাকে লিজার। অঙ্কের জন্যই আজ তার এই দশা।

বাথরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল লিজা। ছুটির ঘণ্টা শুনে চোখ পানি দিয়ে ধুয়ে বেরিয়ে এলো। গেটের বাইরে এসে রাশেদকে দেখে হঠাৎ মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আজকে এর বিহিত করবেই, এমন একটু জিদ নিয়ে রাশেদের দিকে এগিয়ে গেল। আজকে ছেলেটাকে দুটো কথা শোনাতেই হবে।

রাশেদ হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে বলল, “আমি তো তোমাকে ডিস্টার্ব করি না, শুধু দাঁড়ায় থাকি।”

“ক্যান দাঁড়ায় থাকেন? আপনার কোনো কাজ নাই? মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়ায় থাকেন আর তাদের ডাকাডাকি করেন, খুব ভালো কাজ এইটা?”

“আমি তো সবাইকে ডাকি না, তোমাকেই ডাকি।”

লিজার বান্ধবীরা সশব্দে হেসে ফেলে। স্নিগ্ধা একটু জোরেই বলে, “রোমিওর মুখে আজকে কথা ফুটছে রে!”

লিজার ইচ্ছা করে রাশেদের ঢলঢলে শার্টে  আগুন ধরিয়ে দিতে। ওর রাগ কমছে না, স্নিগ্ধার কথা শুনে রাগ আরও বাড়ল।

“আমাকে ডাকেন ক্যান? বলেন, আজকে আপনাকে বলতেই হবে।”

“আমি তোমাকে একটা গিফট দিতে চাইছিলাম।”

“ওহ্ আচ্ছা, একটু আগেই না বললেন কিছু দিবেন না, এখন বলতেছেন গিফট দিবেন?”

“সরি ভুল হইছে। তুমি এমন ভাবে জিজ্ঞেস করলা…”

“আমাকে ক্যান গিফট দিবেন? আপনি কি রাস্তা ঘটে গিফট দিয়া বেড়ান?”

রাশেদ আরেকবার অসহায়ভাবে তার বন্ধুদের দিকে তাকাল। তারা এখনও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে, দুইজনের মুখেই চাপা হাসি।

“না, সবাইকে গিফট দিবো ক্যান? তোমার জন্য একটা ফুলদানি আনছি।” পায়ের কাছে রাখা ঝকমকে কাগজে মোড়ানো একটা চারকোনা বাক্স উঠিয়ে আনলো রাশেদ। লিজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ফুলদানি পছন্দ না হইলে দোকানে বদলাইয়া নিতে পারবা, ভিতরে দোকানের রিসিট আছে, গেলেই বদলাইয়া দিবে।”

লিজা হতভম্ব! ছেলেটা বলে কী! গলা চড়িয়ে বলল, “ফুলদানি দিয়া আমি কী করবো?”

“আমি প্রতিদিন তোমার জন্য একটা ফুল আনবো, তুমি বাসায় নিয়ে এই ফুলদানিতে সাজাইয়া রাখবা।” লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে বলে রাশেদ। বলতে গিয়ে রাশেদের গলা কেঁপে যায়, মনে হচ্ছে আতঙ্কে সে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে।

“ইতর ফাজিল কোথাকার, চেহারা দেখেছিস আয়নায়, মানুষ তো চেহারা দেইখা ভিক্ষাও দিবে না। আবার আসছে ফুলদানি নিয়ে? বলদ কোথাকার। ফুলদানি কেউ কাউকে দেয়? এই ফুলদানি তোর মাথায় ভাঙার আগে এইখান থেকে ভাগ। আর কোনোদিন যদি আশেপাশে দেখছি তাইলে পিটায় লুলা বানায় দিবো।”

আকাশ পাতাল ফাটানো চিৎকার করে বলে লিজা। শরীর কাঁপছে রাগে। রাশেদ এতই অবাক হয় যে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছাড়া ছাড়া কিছুই বলতে পারে না।

লিজা প্রায় দৌড়ে সামনে গিয়ে রিক্সায় ওঠে। পুরো রাস্তা কাঁদতে থাকে ও। পরীক্ষায় খারাপ করে না কি রাশেদের সাথে খাবার ব্যবহার করে এত মন খারাপ লাগছে, ও ঠিক বুঝতে পারে না।

পরদিন রাশেদকে আর দেখা যায় না। তার পরদিনও না। লিজা নিজের অজান্তেই প্রতিদিন স্কুল শেষে রাশেদের অপেক্ষা করে। ওর বান্ধবীরা যখন কালো রোমিওকে ভুলে যায়, লিজা ভুলতে পারে না। এই ভুলতে না পারা নিয়ে নিজের ওপর একটু রাগ হয় ওর।  

রোজায় স্কুল বন্ধ হয়ে যায়।  দিনরাত পড়া নিয়ে ব্যস্ত লিজা একসময় রাশেদের কথা প্রায় ভুলে যায়। ঈদের দিন বিকেলে যখন সব বান্ধবীরা তার বাসায় আসে, কথায়  কথায় রাশেদের প্রসঙ্গ উঠে আসে।  ওর বান্ধবী সুমাইয়ার সাথে নাকি মার্কেটে দেখা হয়েছিল রাশেদের, লিজার কথা জিজ্ঞেস করেছে।

লিজার ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হয়। মন খারাপ লাগা আর ভালোলাগার বিদঘুটে এক মিশ্রণ যেন। বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে চুপচাপ ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ঈদের বিকেলে রাস্তায় অল্পবয়সী ছেলে মেয়েদের বেশ জটলা। ছাদগুলোতেও লোকসমাগম। আকাশটা কেমন কমলা রঙে জ্বলছে। বিষণ্নতা যেন গলে পড়ছে আকাশ থেকে। একটু পরেই বিকেল মিলিয়ে সন্ধ্যা হবে।

লিজা দীর্ঘক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। সেদিন ছেলেটাকে এতটা অপমান না করলেও হতো। মানুষের বাহ্যিক রূপ নিয়ে এত বাজেভাবে মন্তব্য করা মোটেই ঠিক হয়নি। কোনোদিন দেখা হলে সরি বলবে। কিন্তু ছেলেটাকে তো আর দেখা-ই যায় না।

“ঈদের দিন ছাদে একা একা কী করো?” পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠে কথাটা শুনে ভীষণ চমকে গেল লিজা। রাশেদ!

“আপনি এইখানে কী করেন?” লিজা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল।

“রাগ কইরো না। আমি চলে যাবো। দেখলাম তুমি অনেক্ষণ মুখ কালো করে ছাদে ঘুরতেছ, তাই আসলাম।”

“দেখলেন মানে! কীভাবে?”

“ওই যে আমাদের বাসা” বলে আঙ্গুল উঁচিয়ে কাছেই অর্ধনির্মিত একটা দোতলা বাড়ি দেখালো রাশেদ।

“রুমের জানালা দিয়ে দেখলাম তুমি ছাদে ঘোরাঘুরি করতেছ।”

“তাই চলে আসলেন? নিচে দারোয়ান ঢুকতে দিলো?”

“দারোয়ান চাচা আমারে চিনে। এই মহল্লার ছেলে না আমি? সবাই চিনে।”

একটু থামে রাশেদ। তারপর নিচু কণ্ঠে বলে, “আসলে আমি সরি বলতে চাইতেছিলাম। ওইভাবে স্কুলের সামনে দাঁড়ায় থাকা ঠিক হয় নাই।”

মাথা নিচু করে বললো রাশেদ। দুই হাতে আঙ্গুল মটকাচ্ছে। অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝা-ই যাচ্ছে সত্যি ভীষণ লজ্জিত।

“ওহ, আচ্ছা। আমিও অনেক চিল্লাচিল্লি করছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আর স্কুলের সামনে দাঁড়ায় থাকলে এমন বকাবকি করবেই মানুষ।”

“হুম, বুঝতে পারছি। আমি কিন্তু এমনে স্কুলের সামনে দাঁড়ায় থাকি না।”

লিজা আর জিজ্ঞেস করে না কেন দাঁড়িয়ে থাকতো রাশেদ, উত্তরটা ও আন্দাজ করতে পারে। রাশেদ আর লিজার নীরবতার মাঝে বেশ খানিকটা সময় মিলিয়ে যায়। দুজনেই আর কী বলবে ভেবে পায় না। এক সময় রাশেদ বলে, “আচ্ছা, আমি যাই।”

লিজা মাথা নাড়ায়। একবার মনে হয় থাকুক না কালো রোমিও আর কিছুক্ষণ, কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ স্তিমিত হয়ে আসে।

রাশেদ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান শোনা যায়। লিজা বাসায় ফেরার জন্য সিঁড়িতে নামে। খুব অবাক হয়ে দেখে সিঁড়িতে ছোট্ট এক টুকরো পাথর চাপা দেয়া চিঠি!

বুকের ঢিপঢিপানি ফেরত আসে। চিঠিটা রাশেদ রেখে গেছে।

বাসায় ফিরে রুমের দরজা বন্ধ করে কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল লিজা। ভয় কিংবা উত্তেজনায় ওর গলা শুকিয়ে আসছে। এর আগে কেউ তাকে ভালোবাসার চিঠি দেয়নি। ভালাবাসার চিঠিই তো?

“প্রিয় লিজা,
স্কুলের সামনে কোনোদিন কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকব, চিন্তাও করিনি। অথচ দাঁড়ালাম! তোমার বাসার ঠিক উলটো দিকে একটা দোকান আছে, দৈনন্দিন জিনিসপত্র পাওয়া যায়, হাসান ভ্যারাইটি স্টোর। দোকানটা আমার বড়ো ভাইয়ের। আগে আমরা গেন্ডারিয়া থাকতাম। ভাইয়া প্রতিদিন এখানে দোকানে বসত। বাসা থেকে দোকানের দূরত্ব বেশি বলে আমরা এক বছর আগে এখানে চলে এলাম। ভাইয়া অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে মাঝে মাঝে দোকানে বসতাম। বিষয়টা যে আমার খুব ভালো লাগত, তা না। তবুও বসতাম।

একদিন দুপুরে দেখলাম তুমি স্কুল থেকে বাসায় এলে। রিকশা থেকে নেমে একটু সামনে এগিয়ে রাস্তার একটা কুকুরকে পানি খেতে দিলে। তোমার স্কুল ব্যাগেই সম্ভবত আইসক্রিমের খালি বাক্স রাখা ছিলো, ওটাতে করে পানি দিলে। টিফিন বক্স থেকে খাবার বের করে দিলে। কুকুরটা সম্ভবত অসুস্থ ছিল, হাড্ডিসার শরীরের লোম উঠে গিয়েছিল জায়গায় জায়গায়। তারপর তুমি বাসায় চলে গেলে।

ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করল কি না জানি না, আমি খেয়াল করলাম। পরদিনও একই সময় অপেক্ষা করতে লাগলাম। কুকুরটা রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। শরীরে ঘা-এর মতো ছিলো, কেউ কাছে ঘেঁষতে দিতো না। মিথ্যা বলব না, আমাদের দোকানের সামনে এলেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতাম। অথচ তোমাকে দেখতাম প্রতিদিন কুকুরটাকে খাবার আর পানি দিতে। প্রতিদিন ঠিক ওই সময় আমার মতো কুকুরটাও তোমার জন্য অপেক্ষা করত।

একদিন কুকুরটা মারা গেল। একটা গাড়ি কুকুরটার শরীরের উপর দিতে চলে গিয়েছিল। বেচারা এতই অসুস্থ আর দুর্বল ছিল যে নড়তে পারেনি। এলাকার ছেলেরা একটা বস্তায় ভরে কুকুরের মৃতদেহটা কোথায় যেন ফেলে এলো। তুমি যথারীতি স্কুল থেকে ফিরে কুকুরটাকে খুঁজতে থাকলে। এদিক ওদিক একটু হাঁটলে, দুজনকে জিজ্ঞেসও করলে। দুঃশ্চিন্তা ফুটে উঠেছিল তোমার চেহারায়। সাথে মায়া।

ভাইয়া একদিন গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই প্রতিদিন দুপুরবেলা দোকানে এসে বসে থাকিস আর হা করে সামনের বাসার মেয়েটাকে দেখিস, ব্যাপারটা কী ? আগে তো দোকানে আসতেই চাইতি না।” ভীষণ লজ্জা পেলাম। ভাইয়া ব্যাপারটা খেয়াল করেছে!

“ওই মেয়ের বাবা কিন্তু প্রফেসর, মা ব্যাংকে চাকরি করে, ভাই ডাক্তার। তোকে পাত্তা দিবে না। বিষয়টা মাথায় রাখিস।” ভাইয়া সাবধান করল। তবুও আমার ইচ্ছা করল, তোমার সাথে কথা বলি। তোমাকে জানার আগ্রহকে কী বলবো জানি না। প্রেম? হতে পারে।

তোমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে কয়েকদিন ফোন করলাম, তোমার বাবা ফোন ধরে ভারী গলায় বলে, “হ্যালোউউ!” শুনে ভয়ে ফোন রেখে দেই। মাঝে মাঝে তোমার ফোনের কানেকশনই পাই না। বুঝলাম, এভাবে হবে না। তোমার স্কুলের খবর বের করা খুব কঠিন বিষয় ছিল না। একদিন দুই বন্ধুকে নিয়ে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তোমার বাসার সামনে দাঁড়াতে পারতাম কিন্তু সেখানে সবাই আমাকে চেনে। তাছাড়া ভাইয়া তো আছেই।

স্কুলের সামনে দাঁড়াতাম, ফলো করতাম, কথা বলতে চাইতাম। কিন্তু তোমার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। অথচ বুঝতে পারছিলাম তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। একদিন বোকার মত একটা ফুলদানি কিনলাম তোমার জন্য। কিন্তু তারপর সব এলোমেলো হয়ে গেলো। আসলেই তোমার পাশে আমাকে মানায় না। আমি দেখতে ভালো না, তোমার মতো শিক্ষিত পরিবারের ছেলে না। কোন সাহসে তোমার সাথে কথা বলতে যাই?

আমি ভীষণ লজ্জিত। সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিও। তবে কোনোদিন যদি আমার কথা মনে হয়, খুঁজলেই পাবে। কেউ একজন অসীম ভালোবাসা নিয়ে তোমার অপেক্ষা করবে।

ইতি


বি:দ্র: চিঠিটা আমার এক বন্ধু লিখে দিয়েছে। এত সুন্দর করে আমি লিখতে পারি না, তবে ভাবতে পারি। আমার ভাবনাটা ওকে বলেছি, ও সুন্দর করে লিখে দিয়েছে। মিথ্যা বলতে পারলাম না।”

না, এরপর লিজা আর রাশেদের মাঝে কোন সম্পর্ক হয়নি। রাশেদের জন্য মনের গভীরে করুনা থাকলেও অনেক খুঁজে ওর জন্য ভালোবাসা খুঁজে পায়নি লিজা। চিঠিটা অবশ্য ফেলে দিতে পারেনি। অসীম ভালোবাসার চিঠি ফেলা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *