মাই এক্স (১ম পর্ব)

আজকে শেলির বিয়ে। শেলি হচ্ছে আমার বান্ধবী। অন্ততঃ কলেজের দিনে ছিল। কলেজে আমাদের যে গ্রুপ ছিল, সেই গ্রুপের একজন। এটা অবশ্য ওর প্রথম না। সেকেন্ড বিয়ে। প্রথমটা খুব বেশিদিন টেকেনি। কার দোষ তা নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারব না। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ডিভোর্স হয়ে যায়।
আমাদের গ্রুপের সব মেয়েই দেখতে ভাল ছিল। শেলিও দেখতে খারাপ ছিল না। তবে আহামরি কিছু সুন্দরী ছিল না। পড়ুয়া টাইপ ছিল। পড়াশোনায় ভাল। মাস্টার্স শেষে চাকরীও শুরু করেছিল। এরপরে প্রথম বিয়ে। আর আজ দ্বিতীয়বারের মত বিয়ের পিড়িতে বসছে। অনুষ্ঠানটা ছোট্ট পরিসরে করেছে। ক্লোজ রিলেটিভ আর আমরা ক’জন বন্ধু। ক’জনের ভেতরে যারা আছি, ম্যারিডরা সবাই স্পাউস সহই এসেছি।
ইদানীং শেলির সাথেই সম্পর্ক কিছুটা পাতলা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বান্ধবীদের ভেতর যেকজন চাকরি করছে, তার মধ্যে ও একজন। তাই বোধহয়, আড্ডা মারা কিংবা গল্প করার মত সময়ও ওর হাতে তেমন থাকত না। থাকবেই বা কি করে। ব্যাংকের চাকরী । বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছটা। থাকত ভাইয়ের বাসায়। আলাদা খেত। তাই অফিস থেকে ফিরেই রান্নাবান্না অ্যান্ড অল দ্যাট। গল্প গুজব করবে কখন?
সম্পর্ক পাতলা হবার আরও একটা কারণ হয়তোবা ডিভোর্স। কিছুটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগত। দেখা হলে সবাই ‘আহারে’ টাইপ একটা জেস্টার দিত। সহানুভুতি দেখাবার নাম করে আসলে চিমটি কাটত। তাই ডিভোর্সের পর থেকে সবাইকে একরকম অ্যাভয়েড করেই চলত।
বিয়েটা অবশ্য সেকারণে অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম, তা না। আসলে আমার এখন যা স্ট্যাটাস, তাতে এমন ছোটখাট বিয়েতে আসা আমাকে মানায় না। আমার হাজব্যান্ড একটা কোম্পানীর বেশ বড়সড় পোস্টে আছে। ঢাকায় নিজের বাসা আছে। দুজনের জন্য দুটো আলাদা গাড়ী। এধরনের ছোটখাট কমিউনিটি সেন্টারে লাস্ট কবে এসেছি, মনে করতে পারি না। তারপরও এসেছি।
কিছুটা এসেছি, শেলি অনেক করে বলেছে বলে। না আসলে মন খারাপ করত। আর একটা কারণ হচ্ছে, শেলি বলেছিল, সব বন্ধুদের ডেকেছে। অনেকদিন পরে ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, সে কারণেও আসা।

আমাদের বান্ধবীদের, মানে ইউনিভার্সিটিতে আমরা যারা একসাথে পড়তাম, তাদের সবারই বিয়ে গেছে। অ্যাটলিস্ট আমার জানামতে। ছেলে বন্ধুদের ভেতর দু’একজনের হয়েছে। বিশেষ করে যারা ক্লাসমেটের সাথে প্রেম করত, তাদের। অবশ্য উপায়ও ছিল না, প্রেমিকার বয়স হয়ে যাচ্ছে। সো ভাল তেমন কোন চাকরী না থাকলেও বিয়ে করে ফেলেছ।
বাকী ছেলেদের ভেতর, কেউ কেউ করেছে, স্পেশালি যারা ভাল চাকরী জুটিয়েছে কিংবা শ্বশুড় জুটিয়ে দিতে চেয়েছে, তাদের। চাকরী বাকরী যারা পায়নি, তাদেরও কেউ কেউ করেছে, বাট বেশিরভাগই এখনও ব্যাচেলার।
ওদের দেখে মায়াই লাগে। একটা ভাল চাকরীর জন্য কেমন হন্যে হয়ে ঘুরছে। কেউ কেউ রিকোয়েষ্ট করে, আমার বর যদি একটু রিকোয়েস্ট করে দেয়। কিছু হেল্প করি না যদিও, তাও ‘হ্যা বলব’ টাইপ কিছু বলে আশায় রাখি। ভালোই লাগে। নিজেকে কেমন কেউকেটা মনে হয়।
অনুষ্ঠানে আসলে বেশ খানিক্ষণ আগেই এসেছি। বিয়ে আসলে হয়ে গেছে। এটা অনেকটা রিসেপশান টাইপ অনুষ্ঠান। আমরা যারা ঢাকাতে আছি, তাদের ভেতর প্রায় সবাই এসেছে। বেশিরভাগই আমার মত, সবার সাথে দেখা হবে, এই লোভে এসেছে।এমন কোন গেট টুগেদার টাইপ কোন অনুষ্ঠান হলে, তখন সবাই ট্রাই করে আসবার জন্য। দুতিনজন বান্ধবীকে দেখছি। বন্ধুদেরও কয়েকজন এসেছে।

এই ফাঁকে আমার পরিচয়টা একটু দিয়ে নিই। আমি তৃণা। ফাইনান্স নিয়ে মাস্টার্স করেছি। তবে ঐ পর্যন্তই। মাস্টার্সে থাকতেই ভাল ভাল প্রস্তাব আসা শুরু করে। সেখান থেকে বাছ বিছার করে শাহেদকে পছন্দ করা হয়। এরপরে বিয়ে থা। অ্যান্ড, আপাততঃ হাউজওয়াইফ। বিয়ের বছর দেড়েক হয়েছে। এখনও কোন ইস্যু হয়নি। নিচ্ছি, নিব করছি। নিজের সম্পর্কে বলার মত আর তেমন কিছু নেই। এক্সেপ্ট ওয়ান। বেশ সুন্দরী। যেমনটা হলে কবি সাহিত্যিকরা, রুপের বর্ণনা দিয়ে কবিতা টবিতা লেখে, তেমন টাইপের সুন্দরী।
প্রতিটা ফ্রেন্ডগ্রুপে এমন একজন থাকে না, যাকে বাকী বান্ধবীরা বেশ হিংসের চোখে দেখ। আমি সেই টাইপ ছিলাম। দল বেঁধে হেটে গেলে সবার চোখ আমার ওপরই পড়ত। পাড়ার ছেলেগুলোর মনে আগেই ঝড় তুলেছিলাম। কলেজে ঢোকার পরে সেখানে তুললাম। প্রতিদিনই প্রায় আটটা দশটা প্রস্তাব পেতে লাগলাম। এরপরে ইউনিভার্সিটিতে টিচারদের মাথা ঘোরালাম। তবে বিয়ে করলাম, শাহেদকে। ব্রিলিয়ান্ট চ্যাপ। ওর উন্নতি আর দারুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে কারোরই তেমন সন্দেহ নেই।
এনিওয়ে, কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকতেই তারিনের সাথে দেখা হল। ওর হাজব্যান্ড ব্যাংকার। উনিও এসেছেন। আলাপ হল। দেখা গেল বাকী বন্ধুদের ভেতর তিথি, অদিতি, শিউলি আর পরশ এসেছে। শিউলি ডাক্তার। ওর হাজব্যান্ডও। পরশ ব্যাবসা করে। তিথি আর অদিতি আমার মতই। হাউজ ওয়াইফ। আর কেউ এখনও আসেনি। প্রায় সবার সাথেই আমার হাজব্যান্ডের পরিচয় আছে। ও পাশে থাকলে, সবাই দেখি আমাকেও বেশ সমীহ করে। ওর স্ট্যাটাসের ইফেক্ট আর কি। ভালোই লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই অবস্থার জন্য ওরা আমাকে কিছুটা হিংসেও বোধহয় করে। এই ব্যাপারটাও আমি এঞ্জয় করি।
শেলি ডাকছে। ইশারায় বোঝাল একা আসতে। এগিয়ে গেলাম। কেবল আমরা বান্ধবীরা মিলে শুরু করলাম ফটোসেশান। ফটোগ্রাফার কিছু তুলল। বাকী আমরা সবাই নিজেদের মোবাইলে সেলফি তুললাম। এই সুযোগে আমার নতুন আইফোনটাও সবাইকে দেখালাম। ‘ওয়াও, লেটেষ্ট আই ফোন?’ আই জাস্ট লাভড ইট।
শেলির নতুন হাজব্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার। ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। একটা মেয়ে আছে। শেলির অবশ্য কোন ইস্যু হয়নি। একদিক দিয়ে রক্ষা। বাচ্চা সহ কোন মেয়ের বিয়ে হওয়া রিয়েলি টাফ। বিশেষ করে তেমন সুন্দরী না হলে।
ফয়সাল ভাইয়ের সাথে ডিভোর্সের পরে বেশ সমস্যায় পড়ে যায় বেচারী। নেহাত চাকরী করত বলে রক্ষা। ঢাকায় বাবার নিজস্ব বাসা ছিল, বাট ওটা এখন ভাইদের দখলে। একা হয়ে যাওয়ার পরে বাসায় ফিরে যাওয়া ছাড়া তেমন কোন উপায় ছিল না। ওখানে মায়ের সাথে একটা রুমে থাকত। ভাইদের বউগুলো খুব একটা পছন্দ করত না ব্যাপারটা। নেহাত মা বেঁচে আছেন দেখে, সহ্য করে নিয়েছিল।
যাই হোক, এভাবে বছর খানেক চলার পরে, অফিসের এক কলিগ একদিন এই বিয়ের প্রস্তাবটা আনে। দেখলাম ভদ্রলোককে। নাইস লুকিং। মেয়ে আছে বলেই হয়তো শেলির ব্যাপারে মত দিয়েছেন। আগের পক্ষে বাচ্চা না থাকলে, হয়তো কুমারী মেয়েই খুঁজত। যাই হোক, আশা তো করছি এবার বিয়েটা টিকবে। একবার যেহেতু ধাক্কা খেয়েছে, এবার হয়ত শেলিও একটু মানিয়ে টানিয়ে চলবে।
খাবার দাবার সেরে ফেলেছি। সবাই বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে গল্প গুজব করছে। দেখা গেল কখন যেন আমরা চার বন্ধু এক জায়গায় হয়ে গেছি। গল্প করছি এমন সময় শেলি হাত নেড়ে আমাদের ডাকল। এগিয়ে গেলাম। শেলীকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। খারাপ লাগল না। অনেক কষ্ট করেছে বেচারী। ডায়াসে উঠলাম। ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। বিশাল এক সিংহাসনে বসে আছে দুজন।
প্রথমে ভেবেছিলাম, ওর হাজব্যান্ডের সাথে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ডায়াসে উঠে বুঝলাম, ব্যাপারটা তা না। আমাকেই কিছু বলতে চায়। ওর সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে মাথা নীচু করতে বলল। কানে কানে কিছু বলবে মনে হচ্ছে। কান এগিয়ে দিলাম।
— সুমনের ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে?
অবাক হলাম। সুমন ভাই বলতে একজনকেই বোঝানোর কথা। বাট এখানে আসবে কিভাবে? ভ্রু কুচকে শেলির দিকে তাকালাম। আমার অবস্থাটা বুঝল শেলি। চোখের ইশারায় বোঝাল, আমি ঠিকই ধরেছি। হঠাৎ করে বুকটা ধক করে উঠল। এতোদিন পরে কোথা থেকে? মুখোমুখি দেখা হলে কেমন লাগবে? একটা ভয়ও কাজ করল। শাহেদ জানতে পারলে কি ভাববে? প্রথম যে রিয়াকশান হল, তা হচ্ছে, দ্রুত এখান থেকে চলে যাই।
ভয়টা বোধহয় আমার চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সেটা লক্ষ্য করে শেলি বলল
— ভয় পাচ্ছিস কেন?
কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম
— নাহ। ভয় পাব কেন?
আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল শেলি। এরপরে স্মিত হেসে বলল
— ওর ফ্রেন্ড।
উত্তরে কি বলব বুঝে পেলাম না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। স্মাইল দেয়ার চেষ্টা করলাম। হল কি না জানি না। শুধু বললাম
— অনেক রাত হয়ে গেছে রে। ওকে আবার খুব সকাল সকাল বেরোতে হয়।
যা বোঝার শেলি বুঝে গেল। আমাকে আর আটকাল না। স্মিত হেসে বলল
— ফোন করিস।
উত্তর একটা স্মাইল দিলাম। এরপরে যেই ঘুরতে যাব এমন সময় সেই কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম
— তোমার বান্ধবীকে বল আমকেও যেন মাঝে মাঝে ফোন করে।
ঝট করে পেছন ফিরলাম। সামনে তাকালাম। আর সেই সাথে বুঝতে পারলাম আমার মুখ থেকে সব রক্ত সরে যাচ্ছে। সামনে সুমন।
কখন এসে পেছনে দাড়িয়েছে টের পাইনি। ঘুরে দাঁড়িয়েই আবিষ্কার করলাম আমি আর ও একেবারে মুখোমুখি। একসময় যেভাবে লেডিস হোস্টেলের নিচে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে গল্প করেছি, সেভাবে। ও দেখতে এখনও আগের মতই আছে। সেই হ্যান্ডসাম চেহারা। নীল রংয়ের স্যুটে দুর্দান্ত লাগছে। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— মনে আছে? আমি সুমন, ইয়োর এক্স…
চলবে

রাজিয়া সুলতানা জেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *