মাই এক্স ১৩ তম পর্ব

অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দিন দশেক আগেই হাতে পেয়েছিলাম। পরের দিন গিয়ে জয়েনিংও করি। তিথির বরের কলেজে। জয়েনিংয়ের পরে সপ্তাহ খানেক ক্লাস দেয়নি। গত দুদিন থেকে নিচ্ছি। খারাপ লাগছে না। প্রথম দিন কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। গতকাল অনেকটাই কনফিডেন্স ফিরে পেয়েছি। আগামী কালও আছে। সেটার জন্যই এখন পড়ছি।

সবকিছু এমন হঠাৎ করে ঘটতে শুরু করল যে বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে এসব আমার জীবনে। প্রথমে হঠাৎ করে সুমনের ফিরে আসা। এরপরে একের পর এক ঘটনা। শাহেদের চাকরী যাওয়া। শাহেদকে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া। এরপরে সুমনের সেই পুরনো প্রেম ফিরে পাওয়ার জেদ। সেজন্য শাহেদকে খুন করা। শুধু মনে হচ্ছিল, কখন শেষ হবে এই দুঃস্বপ্ন।

দুঃস্বপ্ন থামেনি। সুমনের নোংরামী তখন সবকিছু ছাপিয়ে যায়। ওর আচরণে তখন কেবল, হুমকি আর ক্ষমতার দাপট। একটা সময় পর্যন্ত ভয় পেলেও, যখন ও বলল প্রেমে না পড়লে সুমন ওর প্ল্যান বি এক্সিকিউট করবে, মনে হল, ‘আর না’। এবার রুখে দাঁড়াবার সময়। উত্তর দিতে আমার এক মূহুর্ত দেরী হয়নি। ওর মুখের ওপর সোজা বলে দিয়েছিলাম
— দেন একজিকিউট ইট। আই ডোন্ট কেয়ার।
এরপরে বেরিয়ে আসি। রাস্তায় নেমে প্রথম চিন্তা আসে, কিভাবে ফিরে যাব? শুধু এটুকু জানি, সুমনের সাথে ফিরব না। আমার যত বড় ক্ষতিই হোক, একা ফিরব। রাগে তখন আমি অন্ধ হয়ে আছি। শহর থেকে এতো দূরে, কিভাবে ফিরে যাব, এসব তখন মাথায় কাজ করছে না। এখানকার রাস্তা ঘাটও চিনি না।
নীচে দেখি রিক্সাটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। বললাম,
— ঢাকা যাবে?
রিক্সাওয়ালা প্রথমে অবাক হলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। একটা নিষ্পাপ টাইপের হাসি দিল। ব্যাপারটা বুঝে গেছে। সঙ্গীর সাথে ঝগড়া হয়েছে, বুঝতে পেরে তাই নিজে থেকেই অফার দিল
— এখানে গাড়ী ভাড়া পাওয়া যায়। করে দিব?
এরপরে? এরপরে প্রায় মাস খানেক হতে চলল। তেমন নতুন কিছু আর ঘটেনি। সুমন যেমন হঠাৎ করে আমার জীবনে এসেছিল, তেমন হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেল। আমার সেই রুখে দাঁড়ানোর জন্য? না ওর বোধোদয়? জানি না। তবে সেদিনের পর থেকে আর কোন ফোন নেই, হুমকি ভরা ম্যাসেজ নেই।
প্রথমে ভেবেছিলাম, আমাকে শান্ত হওয়ার সময় দিচ্ছে। এরপরে যখন দেখলাম দিন পনের হতে চলল, সুমনের টিকির দেখা নেই, তখন সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। এর মানে কি? আমার ব্যাপারে ইন্টেরেস্ট শেষ? নাকি ও শুধু শাহেদের সাথে স্কোর সেটল করতে এসেছিল?
কি পেল সুমন? কি ছিল ওর চাওয়া? আমার জীবনটা তছনছ করা? এটাই কি ওর রিভেঞ্জ? কিছুই বুঝতে পারছি না।
মন মানছে না। সুমনের চোখে যে প্রতিহিংসা আমি দেখেছি, ওটা ভুল হতে পারে না। আর প্ল্যান বি? ওটা কি কেবল ফাঁকা বুলি? সুমনকে যতটা চিনেছি, খেলা মাঝপথে ছেড়ে দেয়ার ছেলে ও না।
সেদিনের পর থেকে সুমনের সাথে আর দেখা হয়নি। খুব একটা বাইরে বেরও অবশ্য হইনি। অন্য কোনভাবেও সুমন যোগাযোগের চেষ্টাও  করেনি। বেশ কয়েকবার মোবাইলটা চেক করেছি। নাহ, আমার তরফ থেকে ফোন করার তো প্রশ্নই ওঠে না। চেক করে দেখেছি শুধু মোবাইলটা অ্যাকটিভ আছে কি না। আছে এখনও।
আমার রুটিনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। প্রথম কদিন হতাশা আর কষ্টে কেটেছিল। প্রায় প্রতিদিনই কাঁদতাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করত না। মনে হত এমন সুন্দরী না হলে, হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। মাঝে মাঝে অ্যালবাম খুলে পুরনো ছবিগুলো দেখতাম। শেলি মাঝে মাঝেই ফোন করত। কেমন আছি জানতে চাইত। ওকে আগেই জানিয়েছিলাম, শাহেদ নেই। সুমন কনফার্ম করেছে। শেলিরও কিছু করার ছিল না। কখনও বলত, কি আর করবি। কখনও সান্ত্বনা দিত, ভেঙ্গে পড়িস না, শক্ত হ। কখনও জিজ্ঞেস করত, এখন কি করবি?
সুমনের ব্যাপারে কোন কথা আমিও জানতে চাইতাম না। শেলিও বলত না।
এভাবেই চলছিল। এরপরে দিন পনের আগে, হঠাৎ তিথি ফোন করল। সকাল বেলা। আবার কোন রিকোয়েস্ট? একবার ভেবেছিলাম ধরব না। পরে মত পাল্টালাম। না ধরলে, ফোন করতেই থাকবে ইডিয়টটা। রিসিভ করলাম।
— ঘুমাচ্ছিলি?
এই গাধাটা কি আর কিছু বলে আলাপ শুরু করতে পারে না? এবার আর রাগ দেখালাম না। বললাম
— না। বল।
— চাকরী করবি?
বেশ অবাক হলাম। কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ চাকরী বিলি করে বেরাচ্ছে কেন ইডিয়টটা? বললাম,
— হঠাৎ?
— আমাদের কলেজ কমার্স ডিপার্টমেন্ট খুলছে। লেকচারার নেবে।
— তা আমি কেন?
— না, ভাবলাম তুই ফিনান্সে মাস্টার্স। আর তাছাড়া তোর জন্য আমাদের কলেজের ফাইলটা ওকে হল। তাই…
হঠাৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল।
— মুখ সামলে কথা বলবি।
তিথি বোধহয় এতোটা রিয়াকশান আশা করেনি। থতমত খেয়ে গেল। বলল
— তুই রাগ করিস না প্লিজ। আমি অন্য কিছু মিন করতে চাইনি…
ফোনটা কেটে দিলাম। সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম, বিচ্ছিরী একটা কাজ করে ফেলেছি। তিথি সরল মনেই ফোনটা করেছিল। সুমন ওদের কলেজের ফাইলটা ক্লিয়ার করে দেয়াতে ভেবেছিল, চাকরীটা আমাকে পাইয়ে দিয়ে, কিছুটা গ্র্যাটিচুড দেখাবে। আর আমি?
তিথিকে ফোন ব্যাক করতে গিয়েও করলাম না। করে কি বলব? স্যরি? তখনই আবার শুরু করবে, কিভাবে সুমন হেল্প করেছিল। নাহ, সুমনকে আর কোনভাবেই আর ওর জীবনে ঢোকার সুযোগ দেব না।
ফোনটা না করলেও ব্যাপারটা মন থেকে গেল না। তাই তো। শুধু শুধু একা একা বাসায় কেন বসে আছি। একটা চাকরীর খোঁজ কেন শুরু করছি না। মাস্টার্স করেছি। রেজাল্টও ভাল। শেলিকে ফোন করলাম
— ব্যস্ত?
— কিছুটা। বল।
— আচ্ছা শোন, ভাবছি চাকরী করব।
— তো কর।
— মানে, সারাদিন তো বাসায় বসেই থাকি।
— এক্সপ্লেইন করছিস কেন? ইচ্ছে হলি করবি। তুই করছিস না কেন, সেটাই তো আমার কাছে অবাক লাগছে।
— না, মানে, শাহেদ এতো বড় একটা পোষ্টে ছিল, টাকার অভাব ছিল না, তাই…
শেলি কথা শেষ করতে দিল না। কিছুটা উষ্মা নিয়ে বলল
— তোর কি ধারণা, যাদের বরের টাকা নাই, তারাই চাকরী করে?
শেলি আগে কখনও এভাবে আমার সাথে কথা বলেনি। বুঝতে পারলাম মিসেস শাহেদের স্ট্যাটাস আর আমার নেই। এখন আমার যতটুকু সম্মান, তা কেবল আমার জন্য। আর সেটা তেমন বেশি কিছু না। কোন রকমে বললাম
— রাখি।
বলে ফোনটা কেটে দিলাম। খুব কান্না পাচ্ছে। শাহেদের অভাব অনেকটা সামলে নিয়েছিলাম। আজ যেন দ্বিতিয়বারের মত শাহেদ তার অভাব অনুভব করিয়ে গেল। তৃণা নামের মানুষটার যে কোন অস্তিত্ব নেই, আজকে প্রথম ফিল করলাম। মন হল, শেলি আমার চেয়ে অনেক সম্মানের জীবন পেয়েছে। ওর যতটা সম্মান, তা ওর নিজের জন্য।
ফোনটা আবার বেজে উঠল। তিথি। এই গাধাটার কি মান সম্মান বলে কিছু নাই? কি করব ভাবছি। এমন সময় মনে হল, আমাকে না পেলে ও আবার সরাসরি সুমনকে ফোন করতে পারে। তখন ঘটনা কোনদিকে মোড় নেবে কে জানে। ফোনটা ধরলাম
— বল
তিথি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
— চাকরীটা কর না, প্লিজ।
রাগতে গিয়েও রাগতে পারলাম না। আসলে ওর কথার মাথামুন্ডু বুঝে উঠতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম
— আমার চাকরী নিয়ে তুই মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?
এবার তিথি সত্যিই কেঁদে ফেলল। বলল
— তুই চাকরীটা না করলে, আমার বর খুব সমস্যায় পড়ে যাবে রে।
এবার সত্যিই অবাক হলাম। আমার চাকরীর সাথে ওর বরের চাকরীর কি সম্পর্ক? হঠাৎ মাথায় সম্ভাবনাটা এল। বললাম
— সুমন কি এই শর্তে তোর বরের কাজটা করে দিয়েছিল?
তিথি এখনও কাঁদছে। কোন রকমে নিজেকে সামলে বলল
— না।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম। শুধু জানতে চাইলাম
— তাহলে?
— মানে সরাসরি বলেনি।
সরাসরি বলেনি মানে কি? হিন্ট দিয়েছে? কি হিন্ট? এটাই তাহলে ওর প্ল্যান বি? আমার উপকার করে, আমার মন পাওয়ার চেষ্টা? সেজন্যই আমাকে প্রথমে অসহায় অবস্থায় ফেলল। এবার বিপদ থেকে উদ্ধারের ন্যাকামি? আর কাজটা করাচ্ছে আমার বান্ধবীকে দিয়ে? ইমোশানালি বাধ্য করে? কি করব? সুমনের চাল অনুযায়ী চলব? না…
— তৃণা। শুনছিস?
কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
— বল
— তুই শুধু একটা অ্যাপ্লিকেশানে সই করবি, ব্যস।
প্রস্তাবটায় ‘না’ বলতে গিয়েও বললাম না। হঠাৎ মাথায় চিন্তাটা আসল। সুমনের প্ল্যানটা বোঝার জন্য তিথির কাছ থেকে সব শুনতে হবে। ও কি কি বলেছিল, প্রতিটা ওয়ার্ড আমার জানা দরকার।
— পুরো ব্যাপারটা একটু খুলে বল তো?
তিথির এবার ব্যাপারটা বলল। তিথির বর যে কলেজে আছে, সেটা নতুন। এমপিওভুক্ত ছিল না। পরিচিত কিছু বন্ধু বান্ধব মিলে চাঁদা তুলে কলেজটা দেয়। এরপরে প্ল্যান ছিল ঘুষ টুস দিয়ে বাকী কাজ করাবে। সেক্রেটারীর সাথে দরদাম চলছিল। ও ব্যাটা অনেক টাকা চাইছিল। ওদের কাছে অতো ছিল না। এমন সময় শেলির বিয়েতে সুমনের সাথে দেখা হয়। জানতে পারে সুমন প্রাইম মিনিস্টারের পলিটিক্যাল এপিএস। দারুণ ক্ষমতাধর। তাই তিথির বর ঠিক করে সুমনকে অ্যাপ্রোচ করবে। প্রথমে আমার মাধ্যমে ট্রাই করতে চেয়েছিল। আমি রাগ করছি দেখে সরাসরি সুমনকে বলে। সুমন কাজটা করে দেয়।

তখন সুমন আরও জানায়, সরকারীর জন্য অ্যাপ্লিকেশান কর, আমি পাশ করিয়ে দেব। ওরা করেওছিল, কিন্তু ওটা পাস হয়নি। এরপরে সেক্রেটারী নাকি জানিয়েছে, সুমন নাকি কেবল টিচার্স লিস্ট দেখতে চেয়েছিল। এরপরে ফাইল ফিরিয়ে দেয়। তখন ওর বরের ধারণা হয়, আমার নাম টিচার্স লিস্টে থাকলে, সুমন কাজটা করিয়ে দেবে।
এক মূহুর্ত ভাবলাম। যদি আমার একটা অ্যাপ্লিকেশানে ওদের উপকার হয়, ক্ষতি কি? সিদ্ধান্ত নিলাম, অ্যাপ্লিকেশানটা করি। সরকারী যদি সত্যিই করে দেয় সুমন, তখন না হয় চাকরী ছেড়ে দেব।

বেডরুমের স্টাডি টেবিলটাতেই নিয়মিত পড়তে বসি। ফিল করলাম, কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভব করছি। নিজের একটা পরিচয় তৈরি হতে যাচ্ছে। নিজেকে কেমন পরিপূর্ণ লাগছে। কখন যে বইয়ের ভেতরে ডুবে গিয়েছিলাম, বলতে পারব না। ফোনের আওয়াজে ঘোর কাটল। মোবাইলটা হাতে নিলাম। আননোন নাম্বার। ঘড়ি দেখলাম। রাত এগারোটা। এতো রাতে? কে হতে পারে? ফোনটা ধরলাম। এক অপরিচিত পুরুষ কন্ঠস্বর। নিজের পরিচয় দিয়ে উনি এরপর নিজের কথাগুলো বললেন। শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। বুঝতে বাকী থাকল না, শুরু হয়ে গেছে সুমনের প্ল্যান বি।

চলবে…

-রাজিয়া সুলতানা জেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *