মাই এক্স (১৭ তম পর্ব)

এক্ষুনিই সবাই বেরিয়ে গেল। ওদেরকে বিদায় করার পরে শাহেদ আমার দিকে তাকাল। জানতে চাইল

— কেমন আছ?
মুখে কোন উত্তর এলো না। ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এরপরে শুরু হল আমার হু হু কান্না। এতো কান্না যে কোথায় জমে ছিল, বলতে পারব না। শাহেদ আপ্রাণ চেষ্টা করছে আমাকে থামাতে। আমি পারছি না। শাহেদ আমাকে জড়িয়ে ধরে কোনরকমে বেডরুমে নিয়ে এল। এরপরে বিছানায় বসাল। পরম স্নেহে চোখ মুছিয়ে দিল। এরপরে আমার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তুলল।
— ভয় পেয়েছিলে?
আমি তখনও উত্তর দেয়ার মত অবস্থায় নেই। কেঁদেই যাচ্ছি। শাহেদ উঠে দাঁড়াল। এরপরে পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করল। সেটা বিছানার ওপর রাখতে রাখতে জানতে চাইল
— ফোন ধরনি কেন? এয়ারপোর্টে গাড়ী পাঠাতে বলতাম। শেষে ট্যাক্সি করে আসতে হল।
এবার মুখে কথা ফুটল। জানতে চাইলাম
— তুমি করেছিলে?
— হ্যাঁ
— আমি ভাবলাম…
— সুমন? অন্য নাম্বার থেকে করেছে?
এরপরে কি মনে করে জানতে চাইল
— আমার আগের মোবাইলটা কোথায়?
বেডসাইড টেবিল থেকে ওটা বের করে দিলাম। সুইচড অফ ছিল। বললাম
— ‘তুমি কোথায়’, একথার কি উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না, তাই ওটা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলাম।
মাথা ঝুঁকিয়ে ব্যাপারটায় সম্মতি দিল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— কিভাবে যে বেঁচে ফিরেছি… বিশ্বাস করবে না।
আমি অবাক চোখে শাহেদের দিকে তাকিয়ে আছি। ও বলে চলল
— এখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা বন্ধ গুদাম ঘরে রাখল। ভেবেছিলাম এরপরে জেরা টেরা করবে। কিচ্ছু করল না। অন্ধকার একটা ঘর, আর সেখানে আমি একা। তিনবেলা খাবার দিত। ব্যাস। প্রথম প্রথম কিছুদিন এই ভেবে শান্তি পেলাম যে অন্ততঃ মেরে তো ফেলেনি। এরপরে একদিন দেখলাম, বেঁচে থাকাটাও বিরক্তিকর লাগছে। এভাবে দিনের পর দিন একটা রুমে থাকা যায়?
— তারপর?
— তারপর একদিন, বোধহয় মাস খানেক পরে, এক লোক ভেতরে ঢুকল। বোধহয় অফিসার টাইপ কিছু হবে। সে সোজাসুজি জানতে চাইল, ব্যাঙ্কে কত আছে? আমার বুঝতে বাকী থাকল না ব্যাটাদের আসল ধান্ধা এটাই। এবার সাহস করে বললাম, উনাদের যা ডিমান্ড, আমি মানতে রাজী আছি।
আমি তখনও মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছি। তখন ভদ্রলোক আমার দিকে একটা চেক এগিয়ে দিলেন। ব্ল্যাঙ্ক চেক। তর্ক না করে সিগনেচার করে দিলাম। শুধু জানালাম, ওই অ্যাকাউন্টটা থেকে ফ্ল্যাটের কিস্তি যায়। মনে হয় ওখানে লাখ দশেক আছে। তাই ওর কাছাকাছি অ্যামাউন্টই যেন বসায়।
— এরপরে ছেড়ে দিল?
শাহেদ দুদিকে মাথা নাড়ল। বলল
— এরপরে আবার সেই বন্দী জীবন। এরপরে দুমাস আগে ফিল করলাম, কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। বাইরের গার্ড পাল্টে গেল। এবার অন্য এক অফিসার আসল। বেশ কর্ডিয়ালভাবে জানতে চাইল, আমি কি করি। কোথায় থাকি। বাবা কি করেন।
আমি রুদ্ধশ্বাসে শুনছি সবকিছু। বোধহয় বুঝতে পারছি, কেন দুমাস আগে সবকিছু পাল্টে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা শাহেদকেও বলা যাবে না। তাই চুপ করে থাকলাম। শুধু জানতে চাইলাম
— তারপর?
শাহেদ বলে চলল। নতুন তেমন কিছু ছিল না। ওরা শাহেদের প্রিভিয়াস রেকর্ড চেক করতে শুরু করে। ওর আত্মীয় স্বজনকে ফোন করে। সবাই নাকি জানায় শাহেদ এখন দেশের বাইরে, ট্রেনিং করছে। ওর তেমন কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। এরপরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। একজন সিনিওর অফিসার এবার রুমে আসেন। বেশ ভদ্রভাবেই শাহেদের সাথে কথা বলেন। ক্ষমা চান। বলেন, উনাদের আসলে ভুল হয়ে গেছে। উনারা একটা ডিল অফার করে। শাহেদকে উনারা ছেড়ে দেবেন, বিনিময়ে শাহেদ বাইরে বেরিয়ে কিছু বলবে না। সবাইকে জানাবে ও দেশের বাইরে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিল। শাহেদ রাজী হয়ে যায়। আর সেইমত ওরা শাহেদকে এক মাসের একটা ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিংয়ে কানাডা পাঠায়। একটু আগে ও সেখান থেকে ফিরেছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাসায় আসে। কথাগুলো শান্ত হয়ে শুনলাম। এরপরে জানতে চাইলাম
— কানাডা থেকে তো ফোন করতে পারতে?
— ওটাও বারণ ছিল। আর তাছাড়া সুমন যদি তোমার কোন ক্ষতি করে?
— ওর আর ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই।
কথাটা বলেই বুঝলাম, মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছি। এখন আর পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। শাহেদ ব্যাখ্যা চাইল।
— মানে?
শাহেদের দিকে তাকালাম। ওর চোখে অবিশ্বাস। কিছুটা বোধহয় আনন্দও। আমার দুকাধ আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাল। বলল
— সুমনের আর ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই মানে কি? ওর চাকরী গেছে?
শাহেদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম। প্রমিজ করেছিলাম, কথাটা কাউকে বলব না। ঐ কথাটা ছাড়া বাকীটা অবশ্য বলা যায়। শাহেদের দিকে তাকিয়ে সেদিনের ঘটনাটা বলতে শুরু করলাম।

— সেদিন, সুমন তার দ্বিতীয় ছোবল মারে। অ্যাক্টিভেট করে তার প্ল্যান বি। শাহেদের শোক কাটিয়ে কেবল বাইরে বেরোতে শুরু করেছি। কলেজের চাকরীর তখনও দিন পনের পার হয়নি। এমন সময় ব্যাংকের ম্যানেজারকে হাতে করে সুমন আমাদের ফ্ল্যাট ক্রোক করায়।
শাহেদ শুনছে আর চোখ বড় বড় হচ্ছে। জিজ্ঞেস করল
— তারপর?
— যখন বুঝলাম এসব সুমন করাচ্ছে, তখন পাগলের মত চেষ্টা শুরু করলাম সুমনের সাথে কন্টাক্ট করার। যে নম্বর ও কল করত, সেটায় রিং করলাম, আনরিচেবল। শেলিকে রিকোয়েস্ট করলাম যেভাবে পারে ও যেন সুমনের সাথে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেয়। ওকে বলি, আমি সুমনের সব শর্তে রাজী। তারপরও শেষ রক্ষা হয় না।
— কি হল তখন
— বাসায় ফিরতে গিয়ে লিফটে ওঠার আগেই সুমন ফোন দেয়, জানায় লেডিস হোস্টেলে আমার জন্য একটা সিট বরাদ্দ আছে। বুঝে যাই, ও আজই আমাকে ঘরছাড়া করবে। আর লিফটে শুনলাম আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছে, তখন শেষ আশাটাও হারিয়ে ফেলি।লিফট থেকে বেরিয়ে যখন ফ্ল্যাটের দরজায় তালা, তখন চোখের সামনে অন্ধকার দেখলাম। ঠিক তখন দেবদূতের মত পাশে এসে দাঁড়ায় খোকন ভাই।
— খোকন ভাইটা আবার কে?
— ইউনিভার্সিটিতে আমাদের এক বছরের সিনিওর। সুমন যে পার্টি করত সেই পার্টিরই আর্মস ক্যাডার ছিল। সেটা অবশ্য উনার আসল পরিচয় না। আসল পরিচয় হচ্ছে, বহুদিন আগে, ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে এই মানুষটিই আমাকে হুমকি দিয়েছিল, ‘উনার সাথে প্রেম না করলে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে’।
— মাই গড। দেন?
— যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখি আমি আমার বেডরুমে। পাশে বসে আছেন, সামনের ফ্ল্যাটের ভাবি আর খোকন ভাই। একবার মনে হল স্বপ্ন দেখছি। কিছুক্ষণের ভেতরেই বুঝতে পারলাম, তেমন কিছু না। আমি সত্যিই আমার বেডরুমে।
শাহেদ অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে। চোখে এখনও আতংক। আমি যে সুস্থ শরীরে এখন ওর সামনে ব্যাপারটা ওর যেন মনেই নেই। যাই হোক এরপরের ঘটনায় ভীতিকর আর তেমন কিছু নেই।
আমাকে চোখ খুলতে দেখে খোকন ভাই সবকিছু জানালেন। আজকে শেলির সাথে দেখা। ওর ব্যাঙ্কে কি একটা কাজে গিয়েছিল। ওর কাছে সব জানতে পারে। তারপরই ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এখানে আসে। দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল, এমন সময় দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।
ধন্যবাদ জানালাম। আর তখনই প্রশ্নটা মনে আসে। জিজ্ঞেস করলাম
— আমি ঘরে কিভাবে? দরজায় তো তালা দিয়ে গিয়েছিল।
খোকনভাই স্মিত হাসল। জানাল ব্যাঙ্কের লাগিয়ে দেয়া তালা ভাঙ্গা হয়েছে। কথাটা শুনে আঁতকে উঠলাম। বললাম
— পুলিশ যদি জানতে পারে?
— সেসব আমি হ্যান্ডল করব।
এরপরে কিভাবে কি হল সব ধীরে ধীরে খোকন ভাইয়ের কাছে শুনলাম। আমাকে প্রথমে পাশের বাসায় শুইয়ে রাখা হয়। এরপরে খোকন ভাই ফোন করে পরিচিত এক পলিটিক্যাল শিষ্যকে ডেকে পাঠায়, বলে, তালা ভাঙ্গতে হবে, ব্যবস্থা কর। সে ছেলেটি বেশ করিৎকর্মা। দ্রুত সব ম্যানেজ করে ফেলে। আমাদের ফ্ল্যাটের তালা ভাঙ্গার পরে, আমাকে এনে আমাদের বেডরুমে শুইয়ে দেয়া হয়। ডাক্তারকেও খবর দেয়া হয়েছিল। উনি সব চেক আপ করে গেছেন। বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। প্রেসার ট্রেসার সব ঠিক আছে। অতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্য এমন হয়েছে। একটু রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
খোকন ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। খোকনের সামনে এভাবে শুয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছিল, তাই ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। খোকন ভাই বাঁধা দিতে চাচ্ছিল। বলল, শুয়ে থাক। আমি শুনলাম না। পাশের বাড়ির ভাবিকে ধরে উঠে বসলাম। সত্যিই আমি বেশ খানিকটা সুস্থ বোধ করছিলাম। জানালাম, আমি ঠিক আছি।
পাশের বাড়ীর ভাবি জানতে চাইলেন, উনাকে কি আর থাকতে হবে? জানালাম, আমি ঠিক আছি। আশাকরি আর সমস্যা হবে না।
ভাবি চলে গেলেন। এরপরে খোকন ভাই আমার মুখ থেকে সব জানতে চাইলেন। বললেন
— যা যা ঘটেছে, একেবারে প্রথম থেকে কি সবকিছু বলা যাবে?
ওর প্রশ্ন করার ভেতরে কিছু একটা ছিল। আমি কিছুটা কেন যেন মনে হল, পারলে ও ই পারবে, সুমনকে মোকাবেলা করতে। একেবারে প্রথম থেকে, সেই শেলির বাসায় দেখা হওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে, সব জানালাম। বললাম,
— বুঝে উঠতে পারছি না কি করব।
সব শুনে খোকন ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এরপরে কাকে যেন ফোন করল। ওপাশে ফোন রিসিভ হওয়ার পরে আমার সামনে থেকে উঠে গেল। বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে বেশ খানিক্ষণ আলাপ করে আবার এসে আমার সামনে বসল। মুখ গম্ভীর। মনে হচ্ছে, কিছু করতে পারবে না। ব্যাপারটা জানতে চাইলাম
— কিছুই কি করা সম্ভব না?
খোকন ক্রুর একটা হাসি দিল। চোখে প্রতিশোধের স্পৃহা। বলল
— সুমন আমাকে আর্ম কেসে ফাঁসিয়েছিল, আমি ভুলিনি। এবার আমার পালা।

-রাজিয়া সুলতানা জেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *