মায়া (২ য় এবং শেষ পর্ব)

মেয়েটা প্রতিদিন পার্কে আসে৷ একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসে ৷ মানে যদি সে বসার জায়গা পায়৷ পার্কে কপোত কপোতী রা বাকবাকুম বাকবাকুম করে৷ কাজেই সবসময়ে যে নির্দিষ্ট বেঞ্চিতেই বসতে পারা যায় সেটা ঠিক নয়৷

মেয়েটা যেদিন জায়গা পায় না সেদিন টুকটুক করে হেঁটে চলে যায় জলের কিনারায়৷ স্থলভাগ ঢালু হতে থাকলেই মেয়েটা বোঝে জলের পাশে সে চলে এসেছে৷
হাতের লাঠিটা ভাঁজ করে মেয়েটা বসে পড়ে৷ মেয়েটা দৃষ্টিহীন৷ পৃথিবীর চিরচেনা রঙ গুলো তার কাছে অধরা৷ তার সব ব্যাপার স্পর্শ আর অনুভূতির মাঝে সীমাবদ্ধ৷
মেয়েটার বৃষ্টি ভাল লাগে৷ কেননা বৃষ্টির ঝম ঝম রুম ঝুম শব্দ সে মনের গভীরে উপলব্ধি করতে পারে৷ ঘরে থাকলে জানালায় হাত বাড়িয়ে সে বৃষ্টিকে স্পর্শ করে৷ বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা তার কাছে একেকটি আলাদা শব্দ৷ প্রতি ফোঁটার আলাদা মানে৷
মেয়েটা বাতাস ভালবাসে৷ হঠাৎ ছলকে ওঠা বাতাসের স্পর্শ তার কাছে মানবীয়৷ মনে হয় কেউ যেন প্রবল ভালবাসায় তাকে ছুঁয়ে দিল৷ তার কাছে স্পর্শের অনুভুতিটাও সময়ে ভিন্ন৷ ভোরের বাতাস, রাতের বাতাস কিংবা দুপুরের বাতাস প্রতিটা ছোঁয়ায়ই ভিন্ন আবেগ!
তার মনে হয় ভালবাসার আবেগটাও হয়তো এমন৷ সময়ের সাথে ভিন্নতা নিয়ে উপস্থিত হয়৷

পার্কের অনেকেই মেয়েটাকে চেনে৷ ছোট্ট বাদামওয়ালা, কফি বিক্রেতা, হাওয়াই মিঠাই কীংবা চটপটিওয়ালা৷
ছোট্ট বাদামওয়ালা রশিদ দেখে মেয়েটা জলের ধারে একলা বসে আছে৷ রশিদ খেয়াল করে পেছনের বেঞ্চটা খালি হয়ে গেছে৷ দৌঁড়ে যেয়ে বাদামের টুকরীটা বেঞ্চে রাখে সে৷
হাঁক দেয়, দিদি ভাই বসার জায়গা খালি৷ আইসা পড়েন!
মেয়েটা হাসে৷ ছোট্ট রশিদ মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার হাসি দেখে৷ মাথা নাড়ে৷ আফসোস৷ দিদিভাই কখনও জানবেনা তার হাসিটা কত সুন্দর৷ দিদিভাইটা যে দেখতে পারে না৷ আয়নায় দিদি ভাই এর যে প্রতিবিম্ব পড়ে সেটাও তো দৃষ্টিহীনই৷
মেয়েটা জলের ধার থেকে উঠে আস্তে ধীরে বেঞ্চের দিকে এগোয়৷ হাতড়ে হাতড়ে বসে পড়ে৷
তারপর বলে কি রে রশিদ কেমন আছিস?
রশিদ হাসে৷ মেয়েটা অনুভব করে সে হাসি৷ দেখতে না পেলেও ঠিকই অনুভব করে৷ ছোট্ট রশিদের হাসি তার হৃদয় স্পর্শ করে৷
রশিদ বলে দিদি ভাই বাদাম দিমু!
দিদি ভাই ডাকটা মেয়েটাই ওকে শিখিয়েছে৷ রশিদেরও ডাকটা ভালো লাগে৷ কেমন গালভরা আর মায়াময় ডাক টা!
মেয়েটা বলে বাদাম ! দে খাই৷
রশিদ বলে দিদিভাই ছুইল্লা দিমু?
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে৷ ওরে ছুইল্লা লাগবে না৷ এমনিই দে৷ লবনমরিচ বেশি দিবি কিন্তু!
ঠিক আছে৷ আপনি বসে খাইতে থাকেন ৷ আমি একটা পাক দিয়া আসি৷
মেয়েটা ঠোঙা নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়৷
রশিদ মেয়েটার হাতে ঠোঙা ধরিয়ে দেয়৷
দিদিভাইটা কেমন সামনের দিকে তাকিয়ে ঠোঙা নেয়৷ প্রতিবার৷
রশিদ সেই সময় দিদিভাই এর চোখের দিকে তাকায়৷ মনে মনে বলে আহারে….
ছোট্ট রশিদ অন্যদিকে যেতে থাকে৷ দু’কদম যাবার পরেই মেয়েটা রশিদ কে ডাকে৷
বলেন দিদি ভাই৷ রশিদ জবাব দেয়৷
মেয়েটা বলে ঠান্ডা এক ঝলক বাতাস ঝাপটা দিল রে রশিদ! আকাশে দেখ তো মেঘ করেছে কি না!
রশিদ তার ছোট্ট হাতে চোখের উপরে একটা শেড তৈরী করে আকাশের পানে তাকায়৷ তারপর বলে
হ দিদিভাই৷ বড় বড় মেঘ, আর কালা হইতেছে৷ বৃষ্টি আইয়া পড়বো মনে লয়…আপনে উইঠা পড়েন৷ বৃষ্টিতে ভিজন বালা না৷ তাপ উঠবে৷
বলে রশিদ রওয়ানা হয়৷
মেয়েটা হাসে৷ রশিদের অভিবাবক সুলভ কথাগুলো তার ভাল লাগে৷
মেয়েটা ঠিক করে আজ সে বৃষ্টিতে ভিজবে৷ ভিজলে যদি মন খারাপ ভাবটা যায়৷ কিছুদিন ধরে কিছুতেই তার মন খারাপ ভাবটা কমছে না৷

বড় দু’ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ল৷ রশিদ তার বাদামের টুকরীটা আগেই পলিথিনে মুড়ে নিয়েছে৷ সে যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেখান থেকে দিদিভাই এর বেঞ্চটা দেখা যায়৷ রশিদ বিরক্তিতে মাথা নাড়ল৷ দিদিভাইটা যে কি! ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে ফোঁটায় ফোঁটায়৷ দিদিভাই মূর্তির মতোন বসে আছে৷
বৃষ্টির মধ্যেই রশিদ মেয়েটার উদ্দেশ্যে দৌড় দিল৷ যাবার আগে সাথের একজন কে বলল টুকরী দেহিস৷ আমি দিদিভাইরে এইহানে নিয়া আসি৷ দিদি ভাই তো চোখে দেখে না, কই যাইবো বুঝতেছে না মনে লয়৷

মেয়েটা ঝুম বৃষ্টির মাঝে বসে আছে৷ পার্কের বেঞ্চে৷ হঠাৎ পরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনে সে চমকে উঠে৷ তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়৷ কন্ঠটা সে একবারই শুনেছে৷ তবু স্পষ্ট গেঁথে আছে মাথায়! শব্দই মেয়েটার চিরচেনা জগৎ৷ শব্দেই সে তার চারপাশ চেনে৷ আলো দিয়ে নয়৷

লোকটা মেয়েটার কাছাকাছি এসে দেখলো মেয়েটা একা বসে ভিজছে বৃষ্টিতে৷ লোকটা দু’বার চেষ্টা করলো৷ গলা দিয়ে কোন সুর বের হলো না৷ তৃতীয় বারের চেষ্টায় সে মেয়েটার নাম উচ্চারণ করলো৷

মায়া!

মেয়েটা তার নাম শুনে চমকে উঠল৷ সে চেনে এই কন্ঠটা৷ এটা রিফাতের! রিফাত৷ ও কিভাবে এখানে আসল৷ নাকি মনের ভুল!
না ভুল নয়৷ রিফাত আবার কথা বলল৷

মায়া৷ খুব অবাক হচ্ছো? আমি রিফাত৷ সেদিনের পর থেকে হন্যে হয়ে আমি খুঁজেছি তোমাকে৷ কি যে দিন গেছে একেক টা৷ এভাবে কেউ লুকিয়ে পড়ে বলো!
মায়া দৃষ্টিহীন চোখে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে থাকে৷
অস্ফুট স্বরে বলে, রিফাত! তুমি কিভাবে….!
রিফাত বলে সেটা না হয় নাই জানলে৷
আমি জানতে পারলাম তুমি এখানে এসে বস৷ প্রতিদিন৷ বিকেল বেলা৷
আমি চলে এলাম৷ তাড়াহুড়োয় ডায়রীটা….আনি নি!
মায়া উঠে দাঁড়ায়৷
ভেজা গলায় প্রশ্ন করে, কেন? রিফাত!
রিফাত প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে তুমি আমাকে বললেই তো পারতে৷ তোমার…
মায়া বলে প্রথমেই তো বলিনি৷ পরে যদি শুনে তুমি আমাকে প্রতারক ভাবো, তাই…!

বৃষ্টি জোড়েসোরে নেমেছে৷ রশীদ সামনা সামনি দুটো মানুষকে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখছে৷ বড় মানুষ গুলা বড় অদ্ভুত৷ রশীদের তাই মনে হয়৷ এই ছোট্ট জীবনে অনেক দেখেছে সে৷ অনেক কিছু৷ দিদিভাই আর লোকটার দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বুঝে নেয় সে৷ ঘুরে ছাউনীর দিকে রওয়ানা হয়৷ বুকে একটা সুখ সুখ ভাব তার৷ দিদিভাইর ঐ লাঠির দিন মনে হয় ফুরিয়েছে!

মায়া বলে আমার অনুভুতিটা কি ভাবে যে… হয়তো তোমার কবিতা, তোমার সাথে আলাপচারিতা… আমি ঠিক জানি না রিফাত!

রিফাত কোন কথা না বলে মায়ার হাত টা ধরে৷ বৃষ্টির জলে শীতল হাতটা কিন্তু অন্য এক উষ্ণতা অনুভব করে সে৷

রিফাত শুধু ছোট্ট করে বলে
“ভালবাসি”
মায়া কিছু বলে না৷ শুধু দৃষ্টিহীন চোখে শব্দের উৎসকে ভর করে রিফাতের মুখের দিকে তাকায়৷

হঠাৎই মায়ার মনে হলো রিফাত কে দেখতে পাচ্ছে সে৷ বৃষ্টির যে ফোঁটা গুলো রিফাতের মুখে পড়ছে সেখানে শব্দ একটা অবয়ব তৈরি করছে৷ সেই শব্দের অবয়বে মায়া যেন দেখছে রিফাত কে!

ওরা দু’জন কাঁদছে৷ হাতে হাত রেখে কাঁদছে৷ বৃষ্টির কারণে ওদের চোখের জল আলাদা করা যাচ্ছে না৷

(সমাপ্ত)

-পলাশ পুরকায়স্থ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *