মেঘলা


মেঘলা আজ অনেকদিন পর সাথীকে ফোন করলো । সাথী এমন একজন মানুষ যার কাছে নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় সব বিষয়ে কথা বলা যায়। ছোট বেলায় নানীর মুখে শুনেছে কখনো নিজের মনের গোপন কথা কাউকে বলতে নেই। যদি খুব বেশী ইচ্ছে করে তো গাঙের (নদীর) সামনে বইলা আয় । মেঘলা হাসে আর ভাবে সাথী ঠিক সেই নদী যার কাছে জীবনের কষ্টের একান্ত নিজের কথা বলা যায় ।
প্রতিটি মানুষ আলাদা। তাদের রুচি পছন্দ বা মতের ফারাক থাকবে এটাই স্বাভাবিক । এর মাঝেও দুটো মানুষ এক হয় । একসাথে পথ চলবে বলে অঙ্গিকার করে। মেঘলা জানে এই জীবনে একসাথে থাকাটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই লোক দেখানো বা অভ্যাস ছাড়া আর কিছু নয়।

মেঘলা তার জীবনের প্রথম ভালোলাগা সেই যখন হাই স্কুলে সবেমাত্র গিয়েছে। সেই ছেলেটি যার নাম আজ মনেও নেই। কেমন বোকার মত তাকিয়ে থাকত । মাঝে মাঝে ওদের গাছের কামরাঙা বা পেয়ারা এনে দিত। তারপর একদিন অন্য স্কুলে ভর্তি হবার সুবাদে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।তার কথা কি একেবারে ভুলতে পেরেছে মেঘলা যদি তাই হয় তবে এই সময়ে এসেও কেন সেই মায়াভরা চোখ মনে দোলা দিয়ে যায়! মেঘলা আজ একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করছে। নয়টা থেকে পাঁচটা অফিস বাসায় একমাত্র সন্তান প্রিয়াম আছে শ্বাশুড়ি দেবর নিয়ে সংসার। স্বামী অরুপ একটি ব্যাংকে আছে। ব্যস্ততম প্রতিটি দিন কাটে।বিয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই সে স্ত্রী,তাই জীবনের প্রয়োজনে বা অভ্যাসের কারনেই হোক শারিরিক ভাবে তাকে অরুপ অসংখ্যবার দখল করে নিয়েছে। প্রতিদিন এক রুটিন অফিসের কাজ বাসার কাজ সব শেষ করে যখন ক্লান্ত দেহে বিছানায় তখন কখনও কখনও এলোমেলো ভাবনা এসে জুড়ে বসে । আসলেই কি এই জীবনটা মেঘলা চেয়েছিল! অরুপ তার চাকুরী তার ইগো চারপাশের জগতটা নিয়ে বড় বেশী ব্যস্ত। সেখানে মেঘলাকে আলাদা করে দেখার কোন সময়ই যে আর তার নেই। কলেজ জীবনে হাসিব এসেছিল মেঘলার জীবনে । পাশাপাশি বাসা হওয়ায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা হত প্রতিদিন। চোখে চোখে কত কথা হত। কিন্তু সামনে দেখা হলেই হাসিবকে অচেনা লাগত। সেই আকর্ষণ সেই মায়া কিছুই আর মনে আসত না । অথচ কতদিন দুইজন দুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। আসলে মেঘলা জানেই না হাসিবকে সে জীবনে চেয়েছিল কিনা? হাসিব মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেয় সবাইকে বুঝাতে চেয়েছে সে মেঘলা বিরহে কাতর আর এই বিষয়টাই মেঘলার ভাল লাগেনি। মেঘলা পড়াশোনায় বরাবরই ভাল তাই তার বন্ধু হতে হলেও একটা মিনিমাম যোগ্যতা তার থাকতেই হবে। তবুও হাসিবের বিষয়টা মেঘলাকে মাঝে মাঝেই নাড়া দিয়ে যায়। খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে কি করছে এখন হাসিব! এটা হয়ত ভালোবাসা নয় এক ধরনের অনুরাগ হয়ত।

মেঘলাকে সত্যিই ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে ছিল স্বপ্নময় । তখন সে সবে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। কি সুন্দর ভরাট গলা! যখন কথা হত মেঘলার মনে হত অনন্তকাল শুধু পাশাপাশি দুজন বসে হাতে হাত রেখে তাকিয়েই কাটিয়ে দেয়া যাবে। স্বপ্নময়ের কথায় যেন যাদু ছিল। কতদিন রমনায় হাতে হাত রেখে হেঁটেছে । একদিন স্বপ্নময় তার অফিসে একটিবারের জন্য মেঘলাকে আলিঙ্গন করেছিল। এত মায়া এত মায়া সেই স্পর্শে যা এখনো মেঘলাকে শিহরিত করে। মেঘলা সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসেছিল স্বপ্নময়কে । স্বপ্নময়ের মাঝেই মেঘলা তার স্বপ্নকে খুঁজে পেয়েছিল! সেই ভালোবাসা সেই গভীরতা সেই আবেগ মেঘলা এখনও ভুলতে পারেনা। তাইতো মেঘলা আজও খুঁজে ফিরে তার স্বপ্নময়কে ।

আজ এতদিন পর অন্যের ঘরণী হয়েও মেঘলা তার স্বপ্ন কে একটু হলেও ফিরে পেতে চেয়েছিল! কিন্তু স্বপ্নময়ের জীবনে হয়ত অন্য কারো বাস। তাই মেঘলা যোগাযোগ করলেও স্বপ্ন আর চায়নি মেঘলাকে। সামান্য যোগাযোগ রাখার মাঝেও যে স্বপ্নের কৃপণতা । তাহলে কি মেঘলার জিবনে কোনদিন কোন সত্যি ভালোবাসা হয়েই উঠেনি । তবে কেন সেই একটিবার মাত্র আলিঙ্গন তাকে এত কাঁদায় ! মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন স্বপ্ন কে ফোনে মেঘলা বলেছিল আমি তোমাকে আর বিরক্ত করব না। তুমি না হয় তোমার মত করে আমার সাথে সম্পর্ক রেখ। না এটা কোন শর্ত নয় তোমার সাথে যদি অতীতে কোন সম্পর্ক থেকে থাকে তার ভরসাতেই বলছি। স্বপ্ন মেনে নিয়েছিল। শেষে শুধু বলেছিল ভাল থেকো । না তারপর আর স্বপ্নের সময় হয়নি মেঘলাকে ফোন করার।

আজ অনেকদিন পর সাথি আর মেঘলা একসাথে। কত কথা কত গল্প যেন শেষই হতে চায় না । মেঘলা তার মনের এইসব এলোমেলো ভাবনা নিয়ে বলা কথা সাথী খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। দুই বন্ধুর কথা শেষই হয় না! মেঘলা জানতে চায় তার মাঝে এখনও যে স্বপ্নময় বেঁচে আছে তার জীবনে কি মেঘলা একটুও নেই। যদি তাই হয় তবে অতীতটা কি মিথ্যা ছিল। মেঘলার এই প্রশ্নের উত্তর সাথীর কাছে নেই। হয়ত কারও কাছেই নেই। আসলে এই জীবনে মেঘলাকে কেউ কোনদিন ভালোই বাসে নি।

-হালিমা রিমা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *