যে শহরে বৃষ্টি হয়না (২য় এবং শেষ পর্ব)

মানুষের জীবন হুট করে যে বদলে যেতে পারে তা আমি অন্তত নিজেকে দিয়েই বুঝেছি| বাড়ীর বিষাদের পরিবেশ ছেড়ে আর কান্না লুকিয়ে  বিদায় নিয়েছি| শেষবার নিজের ঘর, বাড়ী আরেকবার ফিরে ফিরে দেখলাম| কবে ফিরবো ঠিক জানি না| জীবন বোধহয় এভাবেই এত বেশি নিষ্ঠুর হয়|

যেতে যেতে মায়ের মলিন মুখ, চোখে অজস্র ভালোবাসা, বাবার নিষ্পাপ চাহনি, হাহাকার করা বুক, ভাই বোনের মমতার কান্না সব ছেড়ে আমি এখন সিলেট এয়ারপোর্টে|
মামার জন্য সিলেটের সাতকরা এবং অন্যান্য জিনিস নেয়ার দায়ে পাঁচশত টাকা দিয়ে সিকিউরিটি পার হলাম| কাঁচামাল নেয়া নাকি নিষিদ্ধ| অবশ্য পাঁচশ/ এক হাজার দিলে সব নিমেষেই হালাল হয়ে যায়| বাধ্য হয়ে দিয়েই লাগেজ বুকিং, ইমিগ্রেশন শেষ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে উঠলাম| সিলেট থেকে দুবাই সরাসরি ফ্লাইট হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম|

বিমানে উঠেই নির্দিষ্ট জায়গায় বসলাম| পাশের সিটে বসা তরুণ ছেলে বার বার মোবাইলে কথা বলছে আর কাঁদছে| এক সময় বুঝতে পারলাম মায়ের সাথে কথা বলছে| সবাই শেষবার কথা বলছে প্রিয়জনের কাছে| আমি চুপচাপ বসে আছি| আমি ইচ্ছে করে বাড়ীতে ফোন দেইনি| সবাই এত বেশি কাঁদছিলো যে আমি আবার সে কান্না শুনতে চাইনি তাই শেষবার বাবার সাথে কথা বলে বিদায় নিয়েই ফোন অফ করে নীরব বসে রইলাম|

দুবাই এয়ারপোর্টে এসে সব কিছু শেষ করে বাইরে এসে মামাকে পেলাম| দুবাইয়ে অসহ্য রকমের গরম সেটা নেমেই টের পেলাম| বাইরে আসার পর বুঝতে পারলাম ভয়ংকর অবস্থা| মামা জানালেন জুন, জুলাই অথবা আগস্টে সূর্য মামা তার অফুরন্ত তেজ দুবাইয়ের ওপর বর্ষণ করতে থাকে। ৫৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে তাপমাত্রা। এসময় এখানে ভুলক্রমে যারা ঘুরতে আসেন, স্বপ্নের দুবাই তাদের জন্য দুঃস্বপ্নের ও নির্দয় হয়ে ওঠে।
তবে এখন এতোটা না হলেও এয়ারপোর্টের স্ক্রিনে বাইরের তাপমাত্রা ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াস লেখা রয়েছে|

এখানে আসার পর শুনলাম এই শহরে অনেকদিন বৃষ্টি হয় না| শেষ কবে হয়েছিলো কারো ঠিক মনে নেই| মরুভূমির এই দেশটাই বেশিরভাগ সময়েই গরম আবহাওয়া থাকে।

এখন অবস্থা অবশ্য পাল্টেছে| আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে দেশটিতে। তাই বৃষ্টির জন্য কৃত্রিম পাহাড় বানাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। আর এ জন্য আরব বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটির রাজধানী দুবাইতে তৈরি হবে ‘বৃষ্টির পাহাড়’। মরুভূমির এই দেশটিতে কৃত্রিম পাহাড় সেখানে বৃষ্টিপাতে বাধ্য করবে।

দুবাইতে এর আগেও কৃত্রিমভাবে মেঘ তৈরির কাজ হয়েছে। কিন্তু এবার বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে স্থায়ীভাবে ‘বৃষ্টির পাহাড়’ তৈরি করতে যাচ্ছে ইউএই।
কৃত্রিম উপায়ে বাতাসের বেগ তৈরি করে মেঘের সৃষ্টি এবং সেই মেঘের কারণে বৃষ্টি হবে এমনটা আশা করেই তৈরি করা হচ্ছে এই মানুষনির্মিত পর্বত। বিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লাউড সিডিং।

মামা এই ব্যাপার নিয়ে বড্ড এক্সাইটিং এ আছেন। দেশে থাকতেও আমাকে নিঁখুত ভাবে প্রায় সময়ই বলতেন| মামা অবশ্য নিয়মিত পত্রিকা পড়েন বলে ,এসবের অনেক কিছুই জানেন|
যত সময় যায় দেশটার প্রতি আগ্রহ আমার ক্রমশ বাড়ছে|

মামার রুমে গিয়ে উঠলাম। ছোট্ট একটা রুমে দ্বিতল বেডের চার বেড এ মোট ৮জন আর নিচে তিনজন মিলিয়ে ১১জন থাকেন| বড় জোর হলে আমদের দেশে ৪/৫জন থাকতে পারে সেই রুমে। মামা , ফোন করে বাড়ীতে জানালেন আমার নিরাপদে আসার কথা| আমি
গোসল করে অল্প খেয়েই একটা বেডে গা এলিয়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম|

দুদিন কেমনে গেলো বুঝিনি| তারপর আকামা ভিসা সব লাগানো হলো| মূলত আমার কাজ ঠিক করা ছিলো না| আমিরাতে যারা আসেন তারা দুই ধরণের ভিসায় আসেন|
সেটা এখানে আসার পর বুঝেছি। লাইসেন্স ভিসা (মূলত দোকান, কোম্পানি টাইপের আকামা) অন্যটা খাদিম ভিসা (মানে ঘরের কাজের ছেলের ভিসা)|

এই দুই ভিসার মাঝে আবার ফ্রি ভিসা থাকে (যদিও ফ্রি ভিসা বলতে কিছু নাই) | একটা চুক্তিভিত্তিক আসা| ভিসা বিক্রি করে আমিরাতি লোকেরা| আসার পর তাকে ছেড়ে দেয়, ইচ্ছে স্বাধীন কাজ করার জন্য|

আমি সেই খাদিম ফ্রি ভিসায় দুবাইয়ে আসলাম। সবকিছু হলো কিন্তু কোন কাজ পাচ্ছিলাম না| দুই মাস হতে চললো আমার কোন কাজ নেই| মামার রুমে থাকি, খাই|

একটা আরবী রেস্টুরেন্টে  চাকরী পেলাম তাও মাত্র ৬০০ দেরহামে (বাংলাদেশি টাকা এক দেরহাম= ২০ টাকা)|
রমজান মাস ছিলো তখন, ডিউটি শুরু হতো দুপুর ১২ টা থেকে পরদিন সেহরি পর্যন্ত|

রান্নাঘরে সাহায্যকারী হিসেবে আমার কাজ ছিলো| বাসন প্লেট এসব ধোয়া মোছা করতে গিয়ে খুব কেঁদেছি প্রথম দিন। কি করবো ? কোন কাজ পাচ্ছিলাম না| মাস্টার্স  দিয়ে এসে যদি রেস্টুরেন্টে  স্বল্প বেতন চাকরী করতে হয় তবে এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে !
এক সপ্তাহ পর আমি আর সেখানে করতে পারিনি অবশ্য।
আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এরপর একটা চাইনিজ দোকানে চাকরী পেলাম| বেতন কিছুটা ভালো| ১৮০০ দেরহাম বেতনের এই চাকরী পেয়ে কিছুটা শান্তি পেলাম|
বিদেশে মামার কলিগের সাড়ে তিন লাখ দিলাম আস্তে আস্তে|

তবে প্রতি মাসের চাকরীর বেতনের মধ্যে নিজের জন্য অল্প খরচ রেখে বাকী সব টাকাই দেশে পাঠালাম। আব্বার কি খুশি তখন| মোটামুটি দুই বছর কিভাবে যে চলে গেলো বুঝিনি|

নিশিতার সাথে যোগাযোগ হয় এর মাঝে| দুজন বিভোর স্বপ্নে মুগ্ধ থাকি| অল্প স্বল্প বিয়ের প্রস্তাব আসে নিশিতার| নানা কায়দায় সেগুলো সে প্রত্যাখান করে|
বাংলাদেশে তখন মোবাইল ফোনের জোয়ার। ডিজুসের মহামারী অবস্থা। হাতে হাতে মোবাইল |
একটা সময় বুঝতে পারলাম রাত বারো টার পর নিশিতার মোবাইল আজকাল ব্যস্ত থাকে অনেক|
আমার যখন কাজ শেষ হয় তখন বাংলাদেশে রাত দুটো| নিশিতাকে সে সময় ফোন দিতে পারি না।
কিন্তু যখনি ফোন দিই তা আজকাল ব্যস্ত দেখি।

অনেকদিন হয়ে গেলো| ব্যাংকের টাকাটা পরিশোধ হয়ে গেলো। আম্মার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পরিবারে কিছুটা শান্তি ফিরে এসেছে|
বোনের বিয়ে ঠিক হলো| আমি দিন রাত পরিশ্রম করে ধার দেনা করে আবার টাকা পাঠাই। বাড়িতে সেটা বুঝতে দেই না|

একটা সময় বোনের বিয়ে হয়ে গেলো| আমার দুই বছরের কাছাকাছি চলে এলো| ভিসার মেয়াদ শেষ দু মাস বাকী| ভাবলাম এক মাস দেশে থেকে আসি| যেহেতু দোকান থেকেই টিকেট করে দেবে| দোকানের ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়, যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে তাই দোকানের প্রাপ্যটা নিতে চাইছিলাম।
শুনলাম আব্বার শরীর কিছু খারাপ| দেরি না করেই দোকান থেকে প্রাপ্ত টিকেট কেটে দেশে এলাম| যদিও দেনা এখনো অনেক বাকী রয়ে গেছে|

আম্মুর মুখে হাসি, আব্বার হাসি ভাইবোনের আনন্দ দেখে নিজেকে অন্যরকম সুখী লাগছিলো|
নিশিতার সাথে দেখা করে বুঝলাম, আগের নিশিতা এখন আর নেই| অনেকটা বদলে গেছে| ডিজুসটাকে বদলে দিয়েছে| যখন তখন ওর ফোন ব্যস্ত|
দেখা করার পর তার মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখিনি।
কেমন যেন ভাবলেশহীন|
সবকিছু অন্যরকম লাগছিলো। মেনে নিতে পারছিলাম না, নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছিলাম সব ঠিক আছে তো।

আমার কাজিন রুমানার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নিশিতা| সেই রুমানার কাছেই শুনলাম ডিজুসের কবলে বদলে যাবার কাহিনী| এই ডিজুস কত শত মানুষের হৃদয় ভেঙ্গেছে তার খবর কজন জানে|
রুমানার কাছে শুনলাম নিশিতার জীবনে এখন আমার প্রিয় বন্ধু সজীব| যে এখন প্রতিষ্ঠিত এক কোম্পানীর ভালো পোস্টে  জব করে|
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না|
রোজ রোজ তারা নাকি দেখা করে|
নিশিতার মুখোমুখি হলাম| নিশিতা এই নিয়ে কথাই বলতে চায় না| সজীবের কাছে গেলে সেও এড়িয়ে চলে। বিশ্বাস পাকাপোক্ত হলো যখন নিশিতার মোবাইল আমার হাতে আসলো| একদিন ওদের ঘরে গিয়ে ওর বিছানায় থাকা মোবাইল হাতে নিয়ে ম্যাসেজ দেখে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনি|
সে সময় বাথরুমে ছিলো নিশিতা। ওদের ঘরে যাতায়াত আমার ছোটবেলা থেকেই ছিলো|

নিশিতার সাথে আর দেখাই করেনি| এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে আবার দুবাই ফিরে আসলাম| বিষণ্ণ মন নিয়ে আবার কাজে যোগ দিলাম| একদিন পর আমাকে জানানো হলো দোকান বিক্রি হয়ে গেছে| আপাতত আমি যেনো অন্য কোথাও কাজ দেখি|

অকূল সাগরে পড়লাম। দেশ থেকে আসলাম| হাতে টাকা নেই| কি খাবো ? থাকার চিন্তা ও করতে হচ্ছে|
আকামার মাত্র এক মাস আছে| আবার ভিসা লাগাতে হলে ৬০০০ দেরহামের বেশি লাগবে।
আমার খাদিম ভিসা দেখে দোকানে কেউ চাকরী দিতে চায় না|

এর মাঝে গাড়ীর গ্যারেজে একটা ছোট্ট চাকরী পেলাম |ধার দেনা করে ৬০০০ টাকা জমালাম। হঠাৎ শুনি আব্বা অসুস্থ| হার্ট এটাক করেছেন।
ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো| আমার কাছে টাকা নেই| ছোট ভাই জানালো টাকা পাঠাতে। উপায়ান্তর না দেখে এই ৬০০০ দেরহাম পাঠালাম।
আকামা লাগানোর চিন্তা বাদ দিয়ে নীরব কাঁদলাম কতোক্ষণ|

সারাদিন কাজ শেষ করে সেদিন রান্না করে খেতে বসলাম|
রুমমেটরা তখন কেউ কেউ ঘুমে| মোবাইল ফোনে রিং বেজেই চলছে| ইচ্ছে করছিলো না ফোন ধরি|
রুমমেট চিৎকার করছে, এই মিয়া তুমি ফোন না ধরলে ফোন অফ করো| সবাই ঘুমাচ্ছে দেখো না|

ছোট ভাইয়ের ফোন দেশ থেকে এসেছে। দেশ থেকে ফোন আসলে বুকের ভেতর কেমন করে ! না জানি কোন বিপদ হলো কিনা !
তাড়াতাড়ি ফোন ধরলাম| ওপাশে নিঃশব্দ কান্না শুনছি। বুঝতে বাকী রইলো না আমার| শুধু বললাম, কখন আব্বা মারা গেছে|
– দুপুর এক টায়| তুমি কি আসতে পারবে ভাইয়া ?ছোট ভাই আর কোন কথাই বলতে পারেনি|
– কি করে বলি ওকে! আমার বুকের ভেতর কতোটা শূন্য  এখন| কি করে যাই ? টিকেট কেনার টাকাও তো নাই| এমনিতে ধার কর্য করে আকামা লাগানোর টাকাটাই পাঠালাম বাড়ীতে।

রুমমেটের একজন কাঁধে চাপ দিয়ে জানতে চাইল, “কি হইছে ভাইয়া?”
আমি কোনো রকমে বললাম, “আমার বাবা মারা গিয়েছে।” কথাটা বলতে গিয়ে মনে হলো গলার ভেতর শক্ত কিছু দলা পাকিয়ে কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে। আমি কাঁদতে চাইছি না, কিন্তু হাউমাউ করে কান্না চলে আসছে। কান্নায় এতো তৃপ্তি, এই প্রথম টের পেলাম!
আমার কান্না দেখে উপস্থিত সবার চোখেও জল ছলছল করছে। মানুষ নাকি অনুকরণীয় প্রাণী। কাউকে কাঁদতে দেখলে সেও কাঁদে, হাসতে দেখলে সেও হাসে। আমার কেন কান্না আসছে বুঝতে পারছি না,।না, আমি দেশে যেতে পারিনি| সব মায়া ছেড়ে আব্বা চলে গেলেন পরপারে। মায়ের অসুস্থতা এখন আগের চেয়ে বেড়েছে| বাবা নেই বলে আম্মার নিজের শরীরের প্রতি উদাসীনতা বেড়েছে।

দুই মাস হয়ে গেলে আমি আর আকামা লাগাতে পারিনি। চুপিচুপি আসি ডিউটিতে আর রুমে যাই চুপিচুপি| এখন প্রতিটি মুহূর্ত সতর্ক হয়ে চলতে হয়| নাহলে কখন অবৈধ হওয়ার জন্য দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় পুলিশ।

কয়েকটা মাস যে কিভাবে গেছে বুঝাতে পারবো না। বাবার প্রতিটি স্মৃতি, আমাকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু একটার পর একটা হারিয়ে যাচ্ছে | না জানি জীবনের আর কত পরীক্ষা দিতে হবে।

নিশিতার অনেক দিন কোন ফোন নেই| আগের নাম্বারে এখন আর ফোন যায় না| সে নিজেকে বদলে ফেলেছে। বুঝতে পেরেছে আমাকে দিয়ে তার ভবিষ্যৎ নেই।
বসে বসে শুধু ভাবি মানুষ কিভাবে এত সহজে বদলে যেতে পারে !
আমার অবশ্য এখন আর কষ্ট হয় না| আমি কষ্টকে ভালোবেসে বুকে আগলে রাখা কবেই শিখে গেছি| কষ্টেরা আমার বুকের ঘরে খায় দায়, তারপর আরাম করে আমার বুকে ঘুমায়|

এভাবে এক বছরের কাছাকাছি সময় চলে গেলো| আরব আমিরাতে তখন একটা সুযোগ এসে গেলো বৈধ হওয়ার|
গ্রামের এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় নতুন করে জরিমানা দিয়ে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরী নিলাম|
সেই বড় ভাই সাহায্য না করলে বোধহয় সম্ভব ছিলো না।
আগের থেকে বেতন ভালো|

বেশ কিছু দিন পর অনেকটা স্বচ্ছল হলাম। দু বোনকে বিয়ে দিলাম| ভাইকে শহরের কলেজে ভর্তি করলাম।
আস্তে আস্তে আমাদের অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো|
অথচ বাবা কিছুই দেখে যেতে পারলেন না|
একটু সুখ উনাকে আমি দিতে পারিনি,এই কষ্ট আমাকে সারাজীবন কষ্ট দিয়ে যাবে|

যথাসাধ্য আম্মুর জন্য করছিলাম| কিন্তু সুখ কপালে বেশিদিন সইলো না|
একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি ভাইয়ের ম্যাসেজ ভাইয়া আম্মু আর নেই।আম্মু এক দুপুরে কেন জানি হঠাৎ করেই হার্ট এটাক আর ব্রেন স্ট্রোক করলেন। হয়তো বাবার চলে যাওয়াটা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি|

বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আম্মু নেই। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।
আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
কোম্পানিকে বলে জরুরী এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশের পথে রওয়ানা দিলাম।

বাড়ীতে গিয়েই মায়ের নিথর দেহ দেখলাম। কদিন আগেই মাকে দেখে গেলাম| আর আজ কোন কথা বলছেন না।
চিৎকার করে বললাম, মা একটা কিছু বলো মা,প্লিজ বলো|

আম্মু কিছুই বলেনি| নিজের হাতে মাকে কবরে শোয়ালাম| কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিলো| ভাই বোনেরা বিলাপ করে কাঁদছিলো| আমি সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। যাদের জন্য এত দূর গেলাম ,যাদের একটু সুখে রাখবো বলে…এত কষ্ট সয়ে সয়ে যাই , আজ তাদের কেউ নেই আমার কাছে|

এরই মধ্যে শুনলাম…নিশিতার বিয়ে হয়েছে পাশের থানায়| ছেলে বাইরে থাকে|
বিয়ের কয়েকদিন পর নিশিতার কি কারণে ডির্ভোস হয়ে যায়| সজীবের সাথে বিয়ে হয়নি। আমার অবশ্য এত সব জানার আগ্রহ নেই।
দেখতে দেখতে আমার ছুটির সময় শেষ হয়ে এলো। যাওয়ার একদিন আগেই মধ্য দুপুরে আমি রুমে বসে আছি।
হঠাৎ নিশিতাকে দেখে চমকে উঠে। আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে। চোখের নীচে কালি পড়ে আছে।
নিশিতাই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে …কেমন আছিস ?

হুম খুব ভালো রে ! তুই কেমন !

আমি ভালো নেই নিবিড় !

যে ভালোর জন্য এতকিছু করলি আর আজ কেন তবে ভালো নেই নিশিতা !

সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই নিবিড়। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস| আমি অন্যায় করেছি| তুই বিদেশ চলে যাবার পর আমি খুব একা হয়ে গেছিলাম| কখন যে সজীব এসে তোর জায়গায় ঢুকে পড়েছিলো বুঝতে পারিনি| একদিন ভিন্ন কিছু হয়ে গিয়েছিলো| আমার অজান্তেই অতি আবেগে সেদিন তোর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলাম|

আমি কিছু শুনতে চাইনা নিশিতা |

প্লিজ আজ তোকে সব বলতে দে ! খুব কষ্টে আছি রে | তোকে বললে শান্তি লাগবে |

আচ্ছা বল !

সজীবের সাথে আমার যা কিছু হয়েছে তা সব ভুল এবং অন্যায়| সেজন্য আর তোর কাছে ফেরত আসতে চাইনি। সজীব আমাকে বিয়ে করবে বলেছিলো কিন্তু সব পেয়ে গেছে আগেই তাই আর বিয়ে করেনি।
তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার অন্য একজনের সাথে বিয়ে হলো।
বিয়েটা বেশিদিন টেকেনি রে। তোর অভিশাপ হয়তো ছিলো।

আমি নীরব হয়ে নিশিতার কথা শুনেই যাচ্ছি| নিশিতা বলেই যাচ্ছে আর অঝোর ধারায় গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু পড়ছে| নিশিতা সে অশ্রু লুকাবার বৃথা চেষ্টাও করছে কিন্তু পারছে না।

আবার নিশিতা বলতে শুরু করে…

জানিস নিবিড়, বিয়ের পর তোকে খুব বেশি মনে পড়ছিলো| খুব কাঁদতাম তোকে মনে করে| কিন্তু তোকে কিছু বলার সাহস নেই রে।

আমার বাচ্চা হয়নি অনেকদিন| যার কাছে বিয়ে হয়েছে তা যে একটা মাতাল ,সেটা আগে থেকে কেউ জানেনি। রাতে মাতাল হয়ে আসতো| যতোদিন দেশে থাকতো সে রোজ রাতে মাতলামি করতো|
সেখানে থাকা অসহ্যকর হওয়ার তালাক দিয়েই চলে আসলাম| এখন চেষ্টা করেছিলাম, মানিয়ে নিতে কিন্তু পারিনি| অবশ্য এটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিবিড়| এখন আমি খুব একা রে | নিবিড় আমার কিছু বলার নেই| শুধু তুই আমাকে ক্ষমা করে দে| আমি আর কিছু চাই না|

নিশিতা কেঁদেই চলছে| এই এতদিন পর প্রথম একটু মায়া হলো ওর জন্য। শুধু বললাম, তোকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। এখন তুই যা প্লিজ । আমার কিছুই ভালো লাগছে না।

এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি আর নিশিতা। চলে গেছে আমার সামনে থেকে। এই প্রথম খেয়াল করলাম, আমার চোখ ভরে গেছে অশ্রুতে|
তবে কি আজও আমি নিশিতাকে ভালোবাসি।
আমার তো তাকে ঘৃণা করা উচিৎ| ঘৃণা কেন আসছে না আমার|

তবে আমি কি ,পাথর হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। আর কিছু ভাবতে পারি না। ঘর থেকে বের হয়ে খোলা আকাশ দেখি।
সব কষ্ট ধুয়ে মুছে ফেলে দিতে পারলে মন হয়তো আমার আকাশের মতো বিশাল হতো।
আকাশে মেঘ জমেছে অনেক| গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে আকাশ। একটু পর হয়তো বৃষ্টি নামবে |

 

-নিলয় আহমেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *