রিবন এবং তার অন্যরকম ভাইটি

সকাল থেকে রিবন বাবাকে অস্থির করে তুলছে। বাবা, কখন মাম্মা আসবে? আমার কিন্তু বোন চাইই চাই।

হাসপাতালে যাবার সময় মাম্মা বলেছিল তোমার জন্য ভাই আনতে যাচ্ছি, কিন্তু রিবনের পছন্দ বোন। নাদিরা মিস বলেছে, ভাই ওর সাথে পুতুল খেলবে না। বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলবে।

দুপুর বারটার দিকে মাম্মা এল। খালামনি গাড়ী থেকে নেমে  বলল,

রিবন সোনা, তোমার জন্য আমরা একটা ছোট পুতুল কিনে এনেছি।

রিবন দৌঁড়ে যায়। পিঙ্ক কালারের টাওয়েল জড়ানো পুতুলটা চোখ পিটপিট করে ওকে দেখছে। একটু হেসেওছিল বোধ হয়।

ওতো হাসছে, আমাকে দেখছে।

হাসবেই তো। এটা যে তোমার ছোট ভাই। কদিন পর তোমার সাথে খেলবে। স্কুলে যাবে।

এটা ভাই? ভাই পঁচা। আমার বোন চাই। সবাই হোহো করে হেসে উঠল। ওর মন খুব খারাপ হয়েছিল। ঘরে গিয়ে খাটের উপর চুপটি করে বসে থাকে। খালামনি পুতুলটাকে ওর কাছে নিয়ে এল।

রিবন মা, দেখ, তোমার ভাই দেখতে অবিকল তোমার মতই হয়েছে। কোলে নেবে না?

রিবন খাটের উপর বাবু হয়ে বসে। খালামনি দুই হাতের  মধ্যে ওকে শুইয়ে দিল।

ওর মুখটা গোলাপী রঙয়ের। হাত পাগুলো রিবনের পুতুল বুবুনের হাত পায়ের চেয়েও ছোট। ও মুখ হা করে হাই তুলছিল। উফ। এত নরম তুলতুলে আর এত ছোট মানুষ হয়, বোন হলে রিবন ওর নাম পিঙ্কি রাখবে বলে ঠিক করেছিল কিন্তু ভাইয়ের নামতো পিঙ্কি দেওয়া যাবে না। তাই ওর নাম দিল পিংকু। বাসার অন্য সবাই ওকে আরিয়ান বলে ডাকে কিন্তু রিবন ডাকে পিংকু।

কত দ্রুত পিংকুটা বড় হয়ে যাচ্ছে। রিবন প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে ওর ঘরে যায়। ও কখনো দোলনায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায় কখনো মায়ের বুকে চুকচুক করে দুধ খায়। রিবন পাশে বসে অপেক্ষা করে কখন ঘুম ভাঙ্গবে। চুপি চুপি হাত পা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। পিংকু জেগে গিয়ে কেঁদে ওঠে। মাম্মা দৌঁড়ে আসে,

রিবন, কি হচ্ছে? জাগিয়ে দিচ্ছ কেন ভাইকে?

মাম্মা, ও এত ঘুমায় কেন?

বাচ্চারা এরকম ঘুমায়। তুমিও ছোট বেলায় ঘুমিয়েছ।

মা হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়ায় আর গুণগুণ করে গান গায়। রিবনও মাম্মার আঁচল ধরে হাঁটে।

পিংকু একসময় হামাগুড়ি দিতে শিখল। চার হাত পায়ে হামা দিয়ে সে রিবনের ঘরে চলে আসে। ওর চারটা ছোট্ট ছোট্ট দাঁত উঠেছে। ময়লা, খেলনা, কাগজ যেটাই সামনে পায় মুখে নিয়ে চিবায়। রিবনের আঙুলে একদিন কামড় বসিয়ে দিয়েছিল। ছোট্ট ছোট্ট দাঁতে কি শক্তি। রিবনের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তবুও ওর উপর মোটেই রাগ হয়নি।

পিংকুর প্রথম জন্মদিনে বাবা কিংস থেকে বিশাল কেক নিয়ে এল। পুরো বাড়িতে নানা রঙের বাতি জ্বলছে। কত আত্মীয় স্বজন। রাজ্যের খেলনা। কিন্তু পিংকুর সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে কেক কাটতে গিয়ে প্রচুর কান্নকাটি করল। বাবা মাম্মাকে বলল, ওকে ঘরে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। বেশি মানুষ দেখে হয়ত ভয় পাচ্ছে।

আরিয়ানের বয়সের অন্য শিশু হাঁটতে পারে কিন্ত ও পারছে না। মাম্মার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আরও কিছুদিন পর পিংকু হাঁটতেও শিখল। একটু করে হাঁটে আবার ধপাস করে পড়ে যায়। কয়েকদিনের মধ্যে ঘরময় এমন দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করল যে ওর জন্য কোথাও কোন জিনিস গুছিয়ে রাখা মুস্কিল হল। ফেলে, ভেঙে সবকিছু তছনছ করে রাখে।

একটু একটু করে ওর বয়স তিনবছর পেরিয়ে গেল। পিংকু বেশ শান্ত হয়ে গিয়েছে। কথা বলে। কিন্তু ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারে না। কোন একটা কথা বলতে গিয়ে শেষ করতে পারে না।  এমনকি মাম্মা আরিয়ান বলে ডাক দিলে সামনে থেকেও খেয়াল করে না। তাকিয়ে দেখে না। রিবন বলে, পিংকু, পিংকু বাবু। পিংকু শোনেই না। নিজে যে কাজ করছিল একমনে সেটা করতে থাকে। পিংকু কেন এমন করে? পাশের বাসার রিদ্মিকের বয়সও তিন বছর। ওকে রিদ্মিক বলে ডাক দিলেই দৌঁড়ে আসে। রিবনের সাথে পাকা পাকা কথা বলে। পিংকু একদম আলাদা। সারাদিন নিজ মনে খেলে। কখনো জিদ করে খেলনা ভেঙে ফেলে। ক্ষুধা পেলে মাম্মার হাত ধরে টেনে ফ্রিজের কাছে নিয়ে যায় কিন্তু কিছু বলে না। মাম্মা ভীষণ চিন্তা করে। সবার কাছে জানতে চায় ও এখনো কিছু বুঝে না কেন? খালামনি হেসে বলে,

তুমি বেশি ভাবো। কোন কোন বাচ্চা সবকিছু দেরীতে করে। দেখ না ও কত পরে হাঁটতে শিখেছে?

পিংকুর পাঁচ বছর বয়সেও ওর আচরণের তেমন কোন পরিবর্তন নেই। শুধু জিদ বেড়ে গিয়েছে। নিজের খেয়ালে চলে। ওর সাথে যেসব কথা বলা হয় সেগুলোই বারবার বলে। ওর জন্য টিভিতে সারাদিন কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে রাখতে হয়। চেঞ্জ করলে চিৎকার করে গড়াগড়ি দেয়। কেউ কোন প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়ে সেটিই রিপিট করে। রিবন বলে, পিংকু বল খেলবে? ও বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে বলে, পিংকু বল খেলবে? ওকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, বাবু তোমার নাম কি? পিংকু রিপিট করে বাবু তোমার নাম কি?

বাসায় ওর বয়সী বাচ্চারা খেলতে আসে কিন্তু পিংকু ওদের সাথে মিশতে পারে না। বেশি হৈচৈ করলেও অস্থির হয়ে যায়। রেগে গিয়ে হাতের কাছে যা পায় সেটা দিয়েই মারতে থাকে। এসব দেখে বাচ্চারা এ বাসায় আসা কমিয়ে দিয়েছে।

ওর আচরণ রিবনের কাছে খুব অদ্ভুত লাগে। অন্য বাচ্চাদের সাথে ওর মিল খুঁজে পায় না। মাম্মাকে বলল, মাম্মা পিংকু এমন করে কেন? ও কেন ডাকলে শোনে না? ও অন্য বাচ্চাদের থেকে অনেক আলাদা, অন্যরকম।

মা খুব রেগে গিয়েছিল।

তোমাকে কে বলেছে আলাদা? বেশি পন্ডিত হয়েছ। যাও পড়তে বস।

একদিন পাশের বাসার আন্টি বেড়াতে এলে মাম্মা পিংকুকে বলল, আরিয়ান আন্টিকে সালাম দাও। পিংকু সালাম না দিয়ে বলল, আরিয়ান আন্টিকে সালাম দাও।

আন্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

ওর বয়স কত?

মাম্মা বলল, পাঁচ বছর।

ভাবী কিছু মনে করবেন না। আপনার বাচ্চার মনে হয় মেন্টাল প্রব্লেম আছে ওকে ডাক্তার দেখান।

মা প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল,

মেন্টাল প্রব্লেম আছে মানে? আমার ছেলে কি পাগল? প্লিজ বাসায় যান আর কখনো এসব বলতে আসবেন না।

মাম্মা কখনো কারো সাথে এভাবে কথা বলে না। রিবন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। আন্টি চলে যাবার পর পিংকুকে মাম্মা প্রচুর মেরেছিল। বারবার বলছিল,

তুই আমার জীবনে একটা অভিশাপ। তুই কেন অন্য বাচ্চাদের মত না? তুই মর। মরলেই আমি বাঁচি। পিংকু খুব কাঁদছে। রিবন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওহ, এত্ত ছোট পিংকু, মাম্মা কেন ওকে মারছে? কিছুক্ষণ পর মাম্মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

সরি, আরিয়ান। আমার জান, কেন তুই কিছু  বুঝিস না বাবা?

পিংকু যত বড় হতে থাকলো বাসার পরিবেশ ততই বদলে যেতে থাকে। মাম্মা খুব কম কথা বলে। মুখে হাসি নেই। পিংকুকে নিয়ে কোন আত্মীয়ের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ বাসায় আসলে রিবনকে বলে,

আরিয়ানকে তোমার ঘরে আটকে রাখ।

কেন মাম্মা?

মাম্মা চাপা ধমক দেয়,

তোমার ভাই পাগল, এটা সবাইকে জানাতে চাও?

রিবনের খুব কষ্ট হয়, আমার ভাই পাগল না। ও হয়ত একটু কম বুঝে কিন্তু পিংকু আর্ট করে অসাধারণ। যে কোন গান সুন্দর তাল লয়ে গাইতে পারে।

মায়ের এসব আচরণে বাবা খুব রেগে গিয়ে বলে,

আমার ছেলে পাগল নয়, তুমি ওকে পাগল বানাবে।

মাম্মা কেঁদে ফেলে।

তাহলে বল, ও কেন অন্য আর দশটা বাচ্চার মত সবার সাথে মিশতে পারে না? ও আমাদের চোখে চোখ রাখতে পারে না। অপরিচিত কাউকে দেখলে লুকিয়ে থাকে কেন? ওর কি চাই সেটা ও বুঝাতেই পারে না। আমরা যেদিন থাকব না সেদিন ওর কি হবে ভেবে দেখেছ?

এরপর বাবা কোন জবাব দিতে পারে না। খালামনি মাকে বলেছিল,

আপু, ওকে তুমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাও। সেদিনও মাম্মা ভয়ংকর রেগে গিয়েছিল, আমার ছেলেকে কেন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব? সে কি পাগল?

বাবা একদিন মাম্মাকে অনেক বুঝিয়ে পিংকুকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেল। যখন তারা ফিরে এল তখন রিবন ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। মাম্মার চোখ মুখ ফুলে আছে। বুঝা যাচ্ছে অনেক কান্নাকাটি করেছে। বাবা গম্ভীর। ও তাদেরকে কিছুই বলতে পারছিল না। পরে বাবার ফোনের আলাপ থেকে বুঝতে পারল পিংকু পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। ডাক্তার বলেছে পিংকু অটিস্টিক বেবী। নিয়মিত কাউন্সেলিং করতে হবে। এক্সট্রা কেয়ার নিতে হবে।

অটিস্টিক কি রিবন জানেনা। মাম্মার কাছে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাচ্ছে না। বাবাও গম্ভীর হয়ে আছে। ওর ভাইটি কেন অন্যরকম হল? পিংকুর জন্য বুকের মধ্যের কষ্টটা অনেকখানি বেড়ে গেল। ওহ! পিংকু আমার আদরের ছোট ভাই, রিবন ওকে জড়িয়ে ধরে । চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। পিংকু ওর ছোট দুটি হাত দিয়ে মুছে দিল। মাঝে মাঝে ও এমন করে। কেউ বকা দিলে রিবনকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকায়। তখন ওকে খুব অসহায় দেখায়। কখনো বোনের মুখে চুমু দেয়। কিন্তু সবই ওর খেয়াল  খুশী মত। রিবনের ইচ্ছামত নয়।

পিংকু সাতে পড়েছে। রিবন ক্লাস এইটে । সামনে সমাপনী পরীক্ষা কিন্তু পড়ায় মন বসে না। আশেপাশের অনেকেই পিংকুকে পাগল ভাবে। মাকে মানসিক হাসপাতালের খোঁজ দেয়। বাচ্চারা কেউ কেউ পিংকুকে দেখলে ক্ষেপায়, আরিয়ান পাগল, আরিয়ান পাগল। ওদের বাবা মা মুখে চুকচুক শব্দ করে মাম্মাকে বলে, আহা এত সুন্দর ছেলে আপনার। কেন যে আল্লাহ ওকে পাগল বানিয়ে পাঠিয়েছে। মাঝে মাঝে ওদের উপর রিবনের খুব রাগ লাগে। বুকের মধ্যে কান্না ঠেলে আসে। আরিয়ান পাগল নয়, ও অটিস্টিক। খালামনি বলেছে অটিস্টিক আর পাগল এক নয়। ওদেরকে কোন কিছু শেখালে শিখতে পারবে। ওরাও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।

মাম্মা ইদানীং প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পড়েছে। বাবা এবং মাম্মা কয়েকটা স্কুল ঘুরে এসেছে কিন্তু কোন স্কুল পিংকুকে ভর্তি করতে রাজী নয়। বলেছে ও যেখানে আই কন্টাক্টই করতে পারে না পড়া শিখবে কিভাবে? কম্পিটিশনে টিকবে কিভাবে? বিভিন্ন স্কুল ঘুরে মাম্মা যখন ঘরে আসে তাকে অসহায় আর বিধ্বস্ত মনে হয়। রিবন বুঝতে পারে না কি করলে মাম্মার মন ভাল হবে। সেদিন মাম্মা ডেকে বলল,

রিবন, আমাকে একটা কথা দাও। বাবা মা সবসময় থাকবে না। আমরা যখন থাকব না তখন তুমি তোমার ভাইকে দেখবে তো? অযত্ন করবে না তো ? তুমি কি জান ওকে সবসময় অন্য কারো ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হবে?

রিবন জানে না। ওর খুব কান্না পেয়েছিল। মা বাবা না থাকার কথা ও ভাবতে পারে না। কেন পিংকু ভাল হবে না? মাম্মা খুব কাঁদছিল। প্রায়ই কাঁদে। রিবন চোখ মুছে দিয়ে জোর গলায় বলে, মাম্মা, পিংকু অবশ্যই ভাল হবে তুমি দেখে নিও।

শেষ পর্যন্ত পিংকুকে কল্যাণপুরে একটি বিশেষ স্কুলে ভর্তি করা হল। মাম্মা সকালে ওকে নিয়ে বেরিয়ে যায়, দুপুরে ফেরে। সন্ধ্যায় বাসায় একজন টিচার এসে ওকে পড়িয়ে যায়। টিচারের কাছে ও লক্ষ্মী ছেলের মত পড়ালেখা করে। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। ওর যেটা মন চায় সেটাই করে। প্রতি শুক্রবার ড্রয়িং ক্লাসে যায়। আঁকার হাত ওর নিখুঁত। যা দেখে অবিকল সেরকম আঁকতে পারে। বাবা আর মাম্মা অটিস্টিক বেবিদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, কিভাবে ও মানসিক ভাবে ইম্প্রুভ করবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।

মাম্মা এখন অনেক ধৈর্যের সাথে পিংকুকে টেক কেয়ার করে। পিংকুর চারপাশে নানা ধরণের খেলনা। বেশীরভাগ খেলনাই বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি। ওর জন্য বাবা অনেক লোগো সেট নিয়ে এসেছে। পিংকু কোনকিছুতেই উচ্ছ্বাস দেখায় না। তবে মনে হচ্ছে ওর ভেতরে খুব সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটছে। ইদানীং কিছু কিছু কথায় ও মনোযোগ দেয় এবং বুঝতে পারে। সেদিন পাশের বাসার রিদ্মিকের সাথে পাজল খেলার চেষ্টা করছে। মাম্মা ওকে সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখে। পিংকু কতবার ডাকে সাড়া দিল। নিজে কতবার অন্যদের সাথে কন্টাক্ট করতে পারল এসব বিষয়ে রিবন নোট লিখে রাখে। পিংকু বিকেলে পার্কে খেলতে যায়। ও বাচ্চাদের সাথে একটু একটু করে মিশছে।

কিছুদিন আগে পিংকুর স্কুলে খেলাধুলা ছিল। রিবন, মাম্মা, বাবা সবাই গিয়েছিল। ওদের সেকশনে পনের বিশ জন বাচ্চা। বেশীরভাগ ওর বয়সী। বেগুনী ড্রেসে প্রত্যেক বাচ্চাকে অদ্ভুত সুন্দর দেব শিশুর মত লাগছিল। একজন ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা চোখ বন্ধ করে রিলে দৌঁড় দিতে গিয়ে পড়ে গেল। মাম্মা বলছিল ও তাকাতে ভয় পায়। ছোট্ট ছেলেটি ভয়ে বারবার টেবিলের কোণে গিয়ে মুখে হাত রেখে লুকিয়ে পড়ছে। টিচার ওকে কোলে করে বাচ্চাদের মধ্যে ছেড়ে দিলে আবার দৌঁড়ে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। এখানে কোন প্রতিযোগিতা নেই। সবাই চ্যাম্পিয়ান। সবার গলায় মেডেল। সবাই সবাইকে হাত তালি দিচ্ছে। টিচারের কথায় পিংকু দক্ষ আর্মি অফিসারের মত পা ঠুকে অতিথিদেরকে স্যালুট করল। মাম্মার চোখ চিকচিক করছে।

রিবনের  চোখেও পানি। ও মনে  মনে বলে,

আমার ছোট্ট ভাইটি, পিংকু। তুমি সত্যি একদিন চ্যাম্পিয়ান হবে। আমি তোমাকে সেই রাস্তায় নিয়ে যাব।

অনেকদিন থেকে পিংকু ওর লোগো সেটের সাথে  দেওয়া একট মডেলের ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। এই মডেলটি বেশ কঠিন। রিবন কয়েকবার চেষ্টা করে মডেলটি তৈরী করতে পেরেছিল। একটা দোতলা বাড়ি, সামনের রাস্তায় বাস, ট্রাক। আরও একটু দুরে পার্কে গাছপালা। বাড়িটির ব্যাল্কনিতে ছোট ছোট গাছ। গেটে দারোয়ান। ছোট্ট ছোট্ট ব্লক দিয়ে তৈরী করতে হবে। একটা  ব্লক এদিক ওদিক হলে মিলবে না। ও বার বার বানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। রেগে মেগে ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়। সেদিন দুপুরে মা যখন ঘুমাচ্ছে রিবন পড়ার টেবিলে। ওর পাশে ব্লকগুলো নিয়ে পিংকু বাড়িটি আবার তৈরি করার চেষ্টা করছে। রিবন মুখ নিচু করে অঙ্ক করছিল। হঠাৎ পিংকু ডাকল,

আপুনি।

পিংকু হাসছে। বিজয়ের হাসি। ও বাড়িটি নিখুঁতভাবে তৈরি করেছে এবং একটি ব্লকও এদিক ওদিক হয়নি। রিবন ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে।

মাম্মা কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।  রিবন মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। চুপি চুপি বলে, কেঁদো না মাম্মা।

-ম্যারিনা নাসরীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *