ললিতা (১ম পর্ব )

কি রে বউ তোর মুখটা এমন মলিন ক্যা!
কই দেখলা তুমি মলিন! মলিন হইতে যাইবো ক্যান!
হারিকেনের আলোতে হারিছ আবার ললিতার মুখখানা ভাল কইরা দেখে। আজ ললিতার ডাগর ডাগর চোখে কাজল নাই, চোখে মুখে হাসি নাই, মুখটা যেন ভুলে গেছে তার নিজস্বতা। ললিতা হারিছের মুখের দিকে তাকায়,”কি দেখতাছেন এমন কইরা?”
—কি আর দেখমু রে, তোরে তো আমি কোন সুখ শান্তিই দিতে পারি না, একটা সন্তানও দিতে পারিনা, ডাক্তররা কয় আমার কি নাকি সমস্যা। কিন্তু ললি তুই তো দেহি বেবাগ হাসিখুশি থাকস, আইজ তোর কি হইছে রে? ”
— “তুমি অত ভাবতাছো কেরে? কিছু হয় নাই,চুপ কইরা খাও তো। সারাদিন মেলা দখল গেছে তোমার উপরে।
হারিছও চুপ করে খেয়ে নেয়, খেতে খেতে হারিছ আপনমনে ভাবে ললিতা তো কখনোই তার সন্তানহীনতার জন্য কোন আক্ষেপ করেনি, দারিদ্রতার জন্য অভিযোগ করেনি, আজ দুএকদিন ধরে ললিতার মুখটা অন্ধকার অন্ধকার, ললিতা কি তাহলে মুখ ফোটে তাকে কিছু বলতে পারছেনা? ললিতা কি কোন কারণে তাহলে কষ্ট পাইতাছে যে কষ্টটা সে হারিছের থেকে লুকাইতাছে!
রাতে ঘুমানোর সময় হারিকেনের আলোটা ক্ষীণ করে দেয় ললিতা। তখন হারিছ তাকে অালতো স্বরে ডাকে,”ললিতা, তোমার মুখটা আমার অচেনা লাগতাছে, ১০ বছর হইছে আমাগোর বিয়ার এর মধ্যে তোমার এই রূপ আমি দেহি নাই কোনদিন! আইজকা কি হইলো! তোমার ভিতরে কি কোন কষ্ট জমা হইছে?আমারে খুইলা কউ দেহি। ”
“কি অইবো আবার! কিছুই অয় নাই, তুমি হুদাই চিন্তা করতাছো! “ললিতা আর কথা বাড়ায় না, পাশ ফিরেই ক্লান্ত ললিতা ঘুমিয়ে গেছে কখন হারিছ টেরও পায়নি।
হারিছ শহরে রিক্সা চালায়, পায়ে প্যাডেল করা রিক্সা দিয়ে তার আয় বড্ড সীমিত। এখন সবাই অটো রিক্সাতে চড়ে,পায়ে প্যাডেল দেয়া রিক্সার কদর কম, এ রিক্সাতে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময়ও বেশি লাগে তাই পেসেঞ্জাররা রিক্সাকে ডাক দেয়ার আগেই রিক্সার দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় এটা ব্যাটারি চালিত রিক্সা কিনা। হারিছ ললিতার সাথে কয়েকদিন বলেছে, এ রিক্সা দিয়া কামাই অয়না রে, বউ। একটা অটোরিক্সা যদি কিনতে পারতাম!” ললিতার সে ক্ষমতাটুকুও নাই, বিয়ার সময় হারিছের মা এক জোড়া চিকন চুড়ি আর একটা নাকফুল দিছিল। স্বর্ণের সে চুড়ি বিক্রি করে হারিছ রিক্সা কিনেছিল আর শহরের এ চালা ঘরটা ভাড়া নিয়ে সংসার সাজিয়েছিল। এখন সম্বল কেবল এ নাকফুলটা,এটা হারিছ কখনোই নিবেনা আর এ টাকা দিয়ে অটো রিক্সাও হবেনা।
ললিতা তাই পাশের পাঁচতলা বাসাটার দুই বাসায় কাজ নিয়েছে, হারিছের হাজার আপত্তিকে উপেক্ষা করেই ললিতা কাজে বের হয়। একটা বাসায় সে শুধু রান্না করে, আরেকটা বাসাতে রান্নাবান্না ঘরদোড় ঝাট দেয়া সবই করতে হয়। এ মহিলা দূরে চাকরি করে তাই সকাল সকাল বেরিয়ে যায় আর অনেক রাতে ফিরে যার ফলে বাসার সবকিছু মুটামুটি ললিতাকেই দেখতে হয়। ললিতা কয়েকমাসের মধ্যে ঐ পরিবারের বিশ্বস্ত একজন হয়ে উঠেছে বিধায় ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের চাবি তার কাছেই দিয়ে রেখেছেন শারমিন। যোগাযোগের সুবিধার্থে তার ব্যবহৃত পুরাতন ফোনটা ললিতাকে দিয়ে রেখেছে সে। ললিতাকে শারমিন ফোন করে জানিয়ে দেয় তার পছন্দের খাবারের কথা, কোথায় কি রাখা আছে সেটাও।আর ললিতাও মনের মাধুরী মিশিয়ে রান্না করে রেখে যায় শারমিনের জন্য। বিছানাপত্র একদম পরিপাটি করে রাখে,বিকালে শারমিনের বর বাসায় ফিরলে ললিতা তার ভাগের খাবারটা টিফিনবক্সে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে আসে।
ললিতা আজকাল খেয়াল করছে শারমিনের বর জুবায়ের তার দিকে কেমন জানি একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে! অকারনে বিকালে আসাটা তার দেরি করে,কখনো টিফিন বক্সে খাবার নেয়ার সময় সে ললিতাকে বাড়তি খাতির দেখিয়ে আরও বেশি করে খাবার আনার জন্য তাগিদ দিচ্ছে যে ব্যাপারগুলো ললিতার কাছে কখনোই ভাল লাগছে না।
ললিতা গ্রামে অভাবী মা বাবার সন্তান ছিল কিন্তু লোভী ছিলনা। ৬ ভাইবোনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ ললিতা সবার খাওয়া হলে তারপর তার মায়ের সাথে বসে ভাত ভাগাভাগি করে খেত। হারিছের সংসারেও সে রাজরানী হয়ে থাকেনি, অভাব অনটনের মধ্য দিয়েই চলছে তার জীবন। সে তার আত্মসম্মানকে সবসময় বড় করেই দেখে,তাই জুবায়েরের এমন আচরণ তার কাছে ভিন্ন ঠেকে।
রূপে ললিতা অপূর্ব সুন্দরী! গোলাপী দুটি ঠোঁট,টানা টানা দুটি চোখ, বেটে আর গোলগাল মুখখানি তার মায়ার পরশ ছড়ায়। সেজন্যই হারিছ ললিতাকে কাজে বের হতে আপত্তি জানায় হাজারো বার।
জুবায়ের সেদিন ললিতাকে বেডরুমে ডাকলো, ললিতা ভয়ে ভয়ে সে ঘরে প্রবেশ করে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করে, “ডাকছেন ক্যান ভাইজান?”
জুবায়ের কিছু সময় ললিতার দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে ললিতার দিকে বাড়িয়ে দেয়,”এইটা নাও।”
একটা বড় প্যাকেট দেখে ললিতা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি আছে এইডাতে, ভাইজান?”
জুবায়ের দাঁত খেঁচিয়ে বলে
— “এটাতে একটা লোশন, তেল আর একটা সাবান। তোমার গায়ে অনেক ময়লা জমেছে, ফর্সা ত্বকটা ময়লাতে ঢেকে যাচ্ছে এগুলো ব্যবহার করবে ”
ললিতা মনে মনে ভাবে এ লোকটা আমার গায়ের দিকেও তাকায় তাহলে? জুবায়ের অাবার জোর করলে ললিতা জোরালো কন্ঠে বলে,” এগুলো আমার পক্ষে নেয়া সম্ভব না ভাইজান, উনি রাগ করবো দেখলে। ”
“রাগ করবে কেন ? মুরাদ নাই মানুষের আবার এত রাগ থাকবে কেন? হারিছের কি চোখে পড়েনা তোমার ফর্সা শরীরটা কালো হয়ে যাচ্ছে! অমন সুন্দরী বউকে দিয়ে কাজ করায় এটাই বেশি। ”
ললিতা জুবায়েরের মুখে এসব কথা শুনে ভিতরে ভিতরে ভীষণ রেগে যায়। সে স্বামীর অপমান কখনোই সইতে পারেনা এবং সহ্যও করেনা। সে গ্রামের টিপিক্যাল পতিভক্ত নারী তাই স্বামীর অপমানে সে রাগে ফোঁসতে থাকে। জুবায়ের আবার প্যাকেটটা ললিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নাও বলছি এটা। ”
ললিতা জুবায়েরের মুখের উপর না করে দেয়,”আমার স্বামীর ক্ষমতা নাই তাই আমার অত বিলাসিতা নাই।গায়ের ময়লা নিয়া ভাইব্যা কি হইবো যদি মনের উপর ময়লা থাহে!” গরগর করে ললিতা শারমিনের বাসা থেকে চলে আসে, রাতের খাবারও আনেনি আজ। হারিছ লক্ষ্য করছে ললিতার মুখটা ভারী, আজ ললিতা নিজে অালুভর্তা ভাত রান্না করেছে তাহলে কি ললিতা…..
নাহ হারিছ আর ভাবতে পারছেনা, সেও অনেক ক্লান্ত আজ। ঘুমিয়ে পড়েছে হারিছও।
ফজরের আযানে ঘুম ভাঙে ললিতার, একটানে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে, নামাজ পড়ে তাকে নিজের সংসারের কাজকর্ম দ্রুত সারতে হবে, তারপর তাকে কাজে বের হতে হবে। অযু করে ফজরের নামাজ শেষ করে ললিতা জায়নামাজে বসে রয়েছে আনমনে, হারিছের ঘুম ভেঙে গেছে অনেক অাগেই,চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে চালা ঘরের টিনের ফাঁকগুলো ভেদ করে পৃথিবীর আবছা অালো তার ভাঙা কুটিরের জায়নামাজে বসে থাকা ললিতাকে আলোকিত করছে। হারিছ শুয়ে শুয়ে ললিতাকে দেখছে। দুই হাতে দুইটা কালো কাঁচের চুড়ি ফর্সা দুটি হাতে যেন কারোর নজর থেকে বাঁচার জন্য কপালের কোণে আঁকা কালো নজরফোঁটা। মাথায় ঘোমটা টেনে নামাজ পড়া মুখটা নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্কের আধার।
বালিশে মুখ ঠেকিয়ে হারিছ চেয়ে চেয়ে দেখছে ললিতাকে অনেকক্ষণ হলো অথচ ললিতার সেদিকে খেয়ালই নেই,অন্যমনস্ক হয়েই বসে আছে সে। হারিছ লক্ষ্য করলো ললিতা অমনোযোগী হয়ে কি যেন ভাবছে। কি ভাবছে এত? এমন অমনোযোগী তো হারিছ কখনোই ললিতাকে দেখেনি! ভোরের নামাজ শেষ করেই যে ললিতা দৌঁড়ে দৌঁড়ে রান্না করে, ঘরদোড় ঝাড়ু দেয়, পাশের কল থেকে পানি আনে তারপর কাজে বের হয় সে ললিতা আজ চুপচাপ জায়নামাজে বসে আছে সেই কখন থেকে। পাখির কিচিরমিচির চারপাশে আরও বেড়ে চলেছে।হারিছ ডাকে,
“ললিতা,ললিতা”
হারিছের ডাকে ললিতার সম্বিত ফিরে, ধরমড় করে উঠে জায়নামাজটা ভাঁজ করে তাকের উপরে রেখে ই ললিতা ভাতের চাল নিয়ে রান্না চাপাতে যায়।উনুনে আগুন ধরিয়ে ভাত বসিয়ে সেখানেই ঠায় বসে থাকে সে। হারিছ লক্ষ্য করছে তার বৌয়ের এমন অসংগত আচরণ আর বারবার হারিছ ভাবছে কেন ললিতা কাল থেকে এমন উদ্ভট আচরণ করতেছে। চনমনে কথা বলা মেয়েটা দুদিন ধরে চুপ করে আছে কেন?
রান্না শেষে অন্যদিন ললিতা হারিছ রে বারবার তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে, হারিছ রে বিদায় করে তারপর ললিতা কাজে বের হয়, সেজন্য সকালে ললিতার দম ফেলারও সময় হয়না কিন্তু আজ ললিতা ধীরে সুস্থে সব কাজ সামলাচ্ছে যেন তার আজ বাহিরে যাওয়ার কোন তাড়াই নেই। খেতে বসে হারিছ দেখছে ললিতা এখনো ভাবনার সাগরে ডুবে আছে
— তোর কি শরীর খারাপ, ললিতা?
চমকিয়ে উঠে ললিতা উত্তর দেয়,
— নাহ্, শরীর খারাপ না।
— তাহলে কি অত ভাবতাছস! কাইল থাইক্যা দেখতাছি তোর মুখ চোখ কেমন জানি ভাবনাত ডুইব্যা রইয়েছে। কাজে মন লাগাইতাছস না! কোন অসুখ টসুখ করছেনি? করলে ক আমার লগে! আমি ছাড়া তো তোর আর কওনের মত তো কেউ নাই।
— অসুখ না! এমনি। আম্মার কথা মনে হইতাছে।
ললিতা মিথ্যে বলে হারিছের সাথে, যদি হারিছকে সত্যটা বলে তাহলে হারিছ তারে বাড়ি থেকে বের হতে দিবেনা আর সব কষ্ট পড়বো হারিছের উপর,সংসারের সমস্ত গ্লানি তার একা টানতে হইবো। তার উপর ললিতা এ পাড়ার এক মাস্টার আপার পরামর্শে এক ডাক্তার দেখাচ্ছে মা হওয়ার অাশায়,সে ডাক্তারের ফি আর ঔষধে অনেক খরচ হয় সব হারিছের পক্ষে একা টানা সম্ভব না।
হারিছ কে বিদায় করে ললিতা ভাবছে আজ কাজে যাবেনা, শারমিন আপাকে আর অপর বাসাতে ফোন করে জানিয়ে দেবে আজ সে যেতে পারবে না। ঠিক ওই সময়ই শারমিন ফোন করে ললিতাকে,
— হ্যালো ললিতা, কি করছো?
— আফা,তারে খাওয়াইয়া বিদায় দিয়া ভাবতাছিলাম আফনেরে ফোন দিয়াম একটা।
— কেন ললিতা কোন সমস্যা?
— না আফা, আসলে… ।
— কি? টাকা লাগবে তোমার?
— না আফা। শরীরটা কেমন লাগতাছে জানি!
— সিরিয়াস কিছু? হলে বলো আমাকে!
— তেমন কিছু না আফা, আসলে মনডা কেমন জানি করতাছে আর মাথাডাও ব্যাথা করতাছে।তাই ভাবছিলাম আইজ কামে যাইতাম না।
— মন খারাপ কেন তোমার? আচ্ছা ললিতা শোন, কাল সরকারী ছুটি আছে,আমার অফিস বন্ধ, কাল তোমার সব কথা শুনবো, তোমার সাথে গল্পও করবো। তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।
— আফনে ফোন দিছেন কেন আফা?
— তোমার ভাইয়া বলছিল তুমি আজ কাজে যাওনি তাই ফোন দিলাম। সকালে তো রান্নাও করে রাখিনি।
— আচ্ছা আফা আমি অহনি যাইতাছি।
— না ললিতা, তেমার যেতে হবেনা । তুমি রেস্ট নাও, বিকাল বিকাল যদি ভাল বোধ কর তাহলে গিয়ে রান্নাটা করো, নাহলে আমিই এসে করবো। রেস্ট নাও তুমি।
—আইচ্ছা আফা।
ফোনটা রেখে ললিতা ভাবে এত ভাল মানুষ আছে পৃথিবীতে? এ ভাল মানুষগুলোই হয়ত জীবনে বেশি ঠকে। অাল্লাহ এদের যেন না ঠকায়।

চলবে….

-অরুন্ধতী অরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *