লেইয়া খাউরী (অতিপ্রাকৃত গল্প)

একটু খানি ভূমিকা…

দেশের প্রায় সব জায়গায় সব অঞ্চলে কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা লোকমুখে ফেরে৷ এর বেশীর ভাগই ভূত পেত্নীতে মাছ নিয়ে যাওয়া পথ রোধ করা ভোলায় ধরা, এমনতর৷ সিলেটের চা বাগান গুলোয় হাওরে পাহাড়ী অঞ্চলে এমন বেশ কিছু কাহিনী আছে৷ যেমন ধরুন এই চা বাগান বা বনবাঁদাড়ের রাস্তায় যারা ফোরস্ট্রোক বা সি এন জি চালায় তাদের এমন কাউকে পাবেন না যারা আপনাকে একটা অতিপ্রাকৃত ঘটনা শোনাবে না৷ আমার লিখা “বন পাহাড়ীর রহস্য” থ্রিলারটিতে আমি এর কিছু উল্লেখ করেছিলাম৷ প্রায় প্রতিটি গল্পেই আছে বিশাল দেহী অতিপ্রাকৃত কিছুর পথ রোধ করে দাঁড়াবার ঘটনা৷

হাওরে বাতি দেখা বা পানি থেকে উঠে আসা দেও(মানে দানব) এর গল্পও চালু আছে৷ বাতি দেখার বৈজ্ঞানিক একটা ব্যাখ্যাও আছে৷ আপনারা জানেন৷ বাকি গুলোর বেশীর ভাগই পরিবর্তিত রাতের পরিবেশে, হ্যালুসিনেশানের ঘটনা বলেই আমার বিশ্বাস৷

সিলেটে আমি সম্পূর্ণ অন্যধরণের একটা প্রচলিত গল্প পেয়েছি৷ যেটা ছোট বেলায় মা’এর মুখে, দিদিভাই (নানী’র) মুখে শুনেছি৷ গতানুগতিক অতিপ্রাকৃত গল্প গুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং এক হিসেবে ভয়ঙ্কর৷ আমাদের দেশের গল্পগুলোতে সাধারণত কাল্ট হররের উপাদান থাকে না৷ কিন্তু ঐ গল্পটায় অনেকটা সে রকমের উপাদানই পরিলক্ষিত হয়েছে৷

পাঠক ভূত বলতে কিছু নেই৷ ভূতের গল্পের মজাটাই হলো ভয় পাওয়া৷ এসব সত্যি বলে ধরে নেবেন না৷ ধন্যবাদ৷

(গল্পের স্থান কাল চরিত্র নাম সব কাল্পনিক৷ কোন মিল নেই কারও বা কোন কিছুর সাথে৷ আর গল্পটার নামের অর্থ হলো যে চেটে খায়৷)

(১)

সোনামুই হাওরটা সিলেটের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে৷ জলের সময় বুরো’র চাষ, মাছ আর হাঁস পালন, এখানকার মানুষের প্রধান তিনটি কাজ৷ চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায়, বর্ষার সময়ে জল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না৷ এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ী যেতে তখন নৌকো লাগে৷

পানি শুকিয়ে গেলে ভিন্ন অবস্থা৷ সোনামুই হাওরের দক্ষিণ পাশটা অবার আলাদা৷ ওখানে বেশকিছু জায়গা জুড়ে জল থাকে সারা বছরই৷ আর সেই সাথে পাওয়া যায় মাছ৷ পুরো হাওরের এই জায়গাটা মাছের অবাধ বিচরণ ভূমি৷ অথচ বিচিত্র কোন কারণে ওখানে দক্ষিণের গভীরে প্রায় কেউই মাছ মারতে যায় না৷ পূর্বজনদের কথা হলো ঐ দক্ষিণাংশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় শ্যাওলা পড়া গাছ আর জলজ জংলার ভেতরে কিছু একটা আছে৷ বহু বহু আগে, ওখানে যেয়ে দু’চারজন, আর ফিরে আসেনি৷ একবার একজনের শরীর পাওয়া গিয়েছিল মাথা থেকে বুক পর্যন্ত! বাকিটা’র কোন হদিস মেলেনি৷ তাও ঝড়ের সময় মৃতদেহের ঐ অংশটা নাকি ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিল এদিকে৷ লোকটা অবশ্য অচেনা ছিল তাদের৷ আসপাশে হারিয়ে যাওয়া কোন এক মানুষ হয়তো৷ চিনতে পারেনি কেউ ই৷

সেই সময় থেকেই জায়গাটা সম্পর্কে দুর্নাম রটে৷ সোনামূই হাওরের দক্ষিণে গভীরে বাধ্য না হলে কেউ যায় না৷

দক্ষিণ হাওরের পাশেই একটা উঁচুনিচু জায়গা৷ বর্ষায় এর খানিক ডুবে খানিক ভাসে৷ ওখানে সাত আটঘর জেলে থাকে৷ আর কেউ না৷ জায়গাটা ছড়ানো আর মানুষও কম৷

চেয়ে চিন্তে খেয়ে দেয়ে মোটামুটি এদের জীবন চলে যায়৷ বাড়ী গুলোর বাসিন্দাদের তাই মোটামুটি সৎভাব৷ সবাই সবার খোঁজখবর রাখে৷

এদিকে শেষ বাড়ীটা ইদ্রিস মাঝি’র৷ নিজের নৌকো আছে৷ জাল আছে মাছ মেরে সে সংসার চালায়৷ তিন ছেলে মেয়ে তার আর বউ৷

এবারের বর্ষা যাই যাই করছে৷ পানিতে টান দিয়েছে৷ কিন্তু মাছ আশানুরূপ পাওয়া যাচ্ছে না৷ গতরাতে ইদ্রিস ঠিক করেছে আজ ভোর বেলায় একটু দক্ষিণে যাবে সে৷ আগেও দু’একবার গিয়েছে৷ মানুষের কথামতো ভয়ের কিছুই দেখেনি সে৷ আর মাছও পেয়েছিল ভাল৷ তাই তার সাহস বেড়েছে৷ আজ চিন্তা করলো আরেকটু ভেতরে যাবে৷ যদি ক’টা বেশী মাছ পাওয়া যায়৷

ভোর বেলা ইদ্রিস বেরিয়ে যায় মাছ মারতে৷ তার ফিরে আসার কথা দুপুরের পূর্বেই৷ তখনও যখন আসল না চিন্তায় পড়ে গেল ইদ্রিসের স্ত্রী৷

আসেপাশের দু’চার বাড়ীতে খবর নিল৷ ইদ্রিসের স্ত্রী’র নাম জুলেখা৷ জুলেখার কথা শুনে পাশের বাড়ীর জরি বলল “খাড়োও৷ তাইন রে ডাক দেই৷”

জুলেখার বাড়ী থেকে জরীর বাড়ী বেশ একটু দূরে৷ অন্ততঃ চিৎকার করে ডাকলে শোনা যেতে পারে এমন দূরত্বে৷

জরী বর কাসু মানে কাসেম বের হয়ে আসল৷ জুলেখাকে বলল “কও কি ভাবী ইদ্রিস ভাই এ আইছে না! ভাইরে তো আমরা সকাল থাকি দেখি নাই৷ ভাই আবার দক্ষিণে গেল না তো! কয়দিন কইছি হেরে বাই বেশী দক্ষিণে যাইয়া কাম নাই!”

কাসু’র কথায় জুলেখার মনে ভয়ের একটা ছাপ দেখা দিল৷

কাসু সাহস দিল৷ বলল “ভাবী খাড়োও৷ আমি যাইয়া দেখি!” এই বলে গামছা আর বৈঠা হাতে কাসু বের হয়ে গেল৷
আসপাশ থেকে দুটো নৌকায় চারজন রওয়ানা হল ইদ্রিস কে খুঁজতে৷

সন্ধ্যের দিকে জরী দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে জুলেখার কাছে আসলো৷ ভাবী বলে ডাক দিল তীক্ষ্ম স্বরে! ওর ডাকে এমন কিছু আছে যে জুলেখা চমকে উঠলো৷

“তেনারে পাওয়া গ্যাছে ভাবী৷ আপনে তাত্তাড়ী ঘাটে যান৷ পোলাপাইন গুলারে আমি দেখুম! যান…”

(২)

জরীর জামাই কাসু দাওয়ায় বসে হুকো টানছে৷ ইদ্রিস কে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা’র দু’হপ্তা পেরিয়ে গেছে৷

জরী ভাত রাঁধতে বাঁধতে বলছে “বুঝলা! জুলেখা বু’র লাইগা আমার খারাপ লাগে! জোয়ান মর্দ স্বোয়ামীর কি যে হইলো লুলা হয়া বিছনাত পইড়া আছে! আইচ্চা হেইদিন কি হইছিল খুইলা কন না ক্যান?”

হুকো তে দু’টো টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কাসু, “বলল কি আর কইতাম বউ৷ হ্যাশ বিহালো ইদ্রিস ভাই এর নাও খান ভাসতে দেহি আমরা! গলুই’র বিতরে ইদ্রিস বাই গোঁ গোঁ কইরা শব্দ কত্তিছে৷ জবান বন্ধ হের! বাউ পা’ওর হাঁটুর এক বিঘত নিচে পাওডা নাই৷ জুলেখা ভাবী তো হেরে দেইখা পটখান খাইয়া কেদার মইধ্যে গেল পইড়া! ইদ্রিদ ভাই রে কত কইছি ভাই দক্ষিণে যাইও না৷ কেডা হুনে কার কথা৷ হেয় তো আমগো মতোন পুরানা মানুষ না৷ দক্ষিণের জলার কতা বিশ্বাস করে না৷ ওহন কি! কি হইলো৷ জবান বন্ধ শরীর নড়ে না৷ পাও একখান নাই.. এই গুলা অশরীরি’র কাম বউ! অশরিরি’র কাম৷ এই বিহাল বেলা হেগো নাম মুখে আইবার চাই না!”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে জরী স্বামীর হুকো টানার শব্দ শোনে৷ তারপর বলে “গঞ্জে যে আপনেরা হেরে লইয়া গেলেন ডাক্তার কিছু কয় নাই?”

“বউ অতো বিদ্যার কথা তো আমরা বুঝি না৷ ত্বয় কইলো হের পাও নাহি কিছু একটায় খাইয়া ফেলছে! আর বিশ্বাস করবা না৷ ঐ জায়গা থাকি রক্ত পড়েনাই এক ফোঁটা৷ মনে লয় কেউ পাও নিয়া ঐহানে মোম লাগাইয়া দিছে! যাউক বউ এই সব বাদ দেও৷”
“চাইর দিকে চউখকান খোলা রাখবা৷ সুময় বালা না৷ পোলাপাইন গুলারে একলা যাইতে দিবা না ৷ রাইতে হেগোরে বাড়ীর পাশেই ইয়ে করাবা৷ দূরে পায়খানায় যাওনেরও দরকার নাই৷ বুঝলা!”

জরী মাথা নাড়ে৷ হু বুঝছে৷ আসলেই দিন কাল খারাপ যায়৷ ইদ্রিসের জন্যে তার খারাপ লাগে৷ খারাপ লাগে জুলেখা বু’র জন্যে৷ ভাতের চুলায় ফু দিতে দিতে সে নিজের সংসারের কথা চিন্তা করে৷ অন্যের সমস্যার কথা ভুলে যায় প্রায়!

বেশ ক’রাত ধরে জুলেখার নাওয়া খাওয়া নেই৷ ঘুমও ঠিক মতোন হয় না৷ ইদ্রিসের সেবা করতে করতে তার সময় কেটে যায়৷ নীরবে চোখের জল ফেলে৷ রাত হলেই কিংবা ভর দুপুরে ইদ্রিসের কাছ থেকে উঠে যাওয়া যায় না৷ ভয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করে সে ৷ মুখে লালা ভাঙে৷ ছেলে মেয়ে গুলো ভয়ে দুরে সরে থাকে!

মাঝে মাঝে জুলেখার’ও ভয় করে৷ চারপাশটা হঠাৎ নীরব হয়ে যায়৷ একটা ঝিঁঝিঁ কিংবা ব্যাংও ডাকে না৷ চারপাশ নিথর হয়ে যায় যেন৷ সন্ধ্যের আগে আগে দাওয়ায় এসে চারপাশটা চোখে রেকি করে জুলেখা৷ কিছু দেখতে পায়না৷ তবু তার মনে হয় , হঠাৎ হঠাৎ চারপাশের চেনা শব্দ থেমে সব নিঝুম হয়ে গেলে মনে হয় এই বাড়ীটাকে দূর থেকে কে যেনো দেখছে৷ সে এলেই যেন পরিচিত শব্দ গুলো থেমে যায়৷

জুলেখা ভয় চোখে চারপাশে তাকায়৷ তার চোখে কিছু ধরা পড়ে না!

“বু’জি ও বু’জি বাড়ী আছো? বু’জি…”

জুলেখা ঘর থেকে বের হয়ে এসে দেখলো এক প্যাঁচে মলিন একটা সাদা শাড়ি পড়া মহিলা দাঁড়িয়ে আছে৷ তার রং কালো৷ দাঁত গুলো মুক্তোর মতো ঝকঝকে৷ মহিলা হাসছে৷

“বু’ আমারে চিনছো?”

“না গো বইন চিনি নাই!”

“বুবু আমি ইদ্রিসের মাম্ তো বইন৷ হেই দুইদিন আগে মাদানে হুনছি বাইজানের খবর৷ আমি হাত পা ঝাড়া মানুষ তাও সব গোছাইয়া আইজ সকালে পথ দিছি৷ বাই আমারে খুব আদর করতো৷ হের শইল খারাপওর খবর হুইন্না ছুটে আইলাম!”

জুলেখা সন্দিহান৷ ইদ্রিস তাকে মামাতো বোনের কথা বলেছিল৷ কিন্তু পক্ষাঘাত গ্রস্থ ইদ্রিস কি সঠিক চিনতে পারবে?

“তোমার নাম কি বইন?” জুলেখা শুধায়৷

“চকচকে সাদা দাঁতে সে হেসে দলে আমার নামি শামলি বুবু৷ বুঝছি নাম শুনে অবাক হইছো৷ শ্যামলী থেকে শামলি হইছে বুবু৷ বিধবা হইছি বচ্চর পাঁচ৷ বাইজানের কাছে চলেন৷ আমারে দেখলেই চিনবো৷ চউখের দিকে নজর দিলেই বুঝবেন৷”

জুলেখা’র মন চাইছে না৷ তারপরও সে স্বামীর কাছে শামলি’কে নিয়ে গেল৷ ইদ্রিস তখন খোলা চোখে উপরে বর্গার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ বর্গা বলতে মোটা বাঁশ আর চালা হিসেবে ছন৷

শামলি ইদ্রিসের পাশে বসে বসলো ও ভাইজান আমি শামলি৷ ইদ্রিস ফিরে তাকালো না৷ জুলেখা স্বামীর ঘাড় ঘুরিয়ে দিল৷ শামলি ইদ্রিসের মাথায় হাত দিয়ে বলল “বাইজান আমি৷ শামলি তোমারে দেখবার আইছি৷ এমন ক্যামনে হইল বাইজান!”

ইদ্রিসের চোখের মনিতে একধরণের নাড়াচাড়া দেখা গেল৷ পক্ষাঘাত গ্রস্থ হাত তোলার পা নাড়ানোর চেষ্টা করছে সে৷ বাম চোখের কোনা বরাবর নামল অশ্রু ধারা৷

“দেখছো ভাবী, বাইজান আমারে চিনতে পারছে৷” হাই তুলতে তুলতে জুলেখা বলল “হ’ তাই তো মনে লয়৷” গত কয়েকদিন ধরে সারা রাত প্রায় জেগে থাকা স্বামীর সেবা করা বাচ্চাদের আগলে রাখা সব মিলিয়ে সে ভীষণ ক্লান্ত৷ মাথা যেন ঠিক কাজ করছে না৷
শামলি আর সে দাওয়ায় এসে বসলো৷ বেলা পড়ে আসছে৷ শামলি বলল “বুবু তুমি বস৷আমারে দেখাই দেও চাউল কই ভাত রান্ধি৷”জুলেখা বলল “ঐ ওখানে আছে সব” বলে রান্না ঘর দেখিয়ে দিল৷

সন্ধ্যে হয় হয় ৷ শামলি’র রান্না ভাতের সুবাস ছড়াচ্ছে চারপাশে৷ দাওয়া থেকে উঠোন পেরিয়ে সামনে দাঁড়ালো জুলেখা৷ চারপাশে ভাল করে তাকালো৷ যতদূর দৃষ্টি যায় দেখলো৷ শুকনো কাদা কচুরী পানার পঁচন এঁদো জলের গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা দিল তার৷ এটা এসব অঞ্চলের স্বাভাবিক ঘ্রাণ৷ তবু কেমন যেনো একটা অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে চারপাশে ঠিক ধরতে পারছে না জুলেখা৷

যেমনি দাওয়ায় পা রাখল তখনই আচমকা অস্বাভাবিকতাটা ধরতে পারলো জুলেখা, আজ চারপাশটা নীরব৷ বড় বেশি৷ একটা ঝিঁ ঝিঁ পর্যন্ত ডাকছে না৷ কবরের নিঃস্তবদ্ধতা নেমে এসেছে যেন!

বেশ কিছুদিন পর রাতে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘুমোলো জুলেখা৷ শামলি বলেছে আজ বাইজানের সাথে সে থাকবে৷ জুলেখাকে জোর করে বাচ্চাদের কাছে শোতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ বলেছে “আমি যে কয়দিন আছি একটু সুখ কইরা নেও৷ গেলেগিয়া তো তোমারই করন লাগব৷”

রাত তখন প্রায় দেড়টা৷ গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জুলেখার৷ তার স্বামী ইদ্রিস গোঙাচ্ছে৷ মনে মনে চিন্তা করলো শামলি কি ঘুমিয়ে গেল?

“শামলি৷ ও শামলি৷ ঘুমাই গেলা?”
“না গো বুবু!”

“তোমার বাইজান গোঙায় ক্যান?”

“আরে বুবু পেশাব করছে৷ সব হরায়ে ঠিক করি, তাই৷”

“আইচ্চা।” বলে পাশ ফিরল জুলেখা৷ তখনই মনে হলো সুড়ুৎ মতোন একটা শব্দ হয়েছে৷ অনেকটা সেমাই টেনে খাবার মতোন৷ জুলেখার কৌতুহল হল৷ দুই ঘরের বেড়ার মধ্যে একটা ছিদ্র আছে৷ সহসা কারও চোখে পড়ে না৷ ছেলে পিলে ওঘরে ঘুমালে রাতে যাতে দেখতে পারে ৷ ওঘরে একটা কুপি জ্বালিয়ে রেখেছে জুলেখা৷

ফুটোতে চোখ দিয়েই ভয়ে তার শিঁড়দাড়া দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল৷ একি দেখছে সে!

শামলি তো আস্তো একটা পিশাচ৷ আধহাত বা তারও বেশি লম্বা জিহব্বা লকলক করছে৷ আবছা অন্ধকারে হাত আর আসপাশের যতটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানে মাছের মতোন আঁইশ৷ ইদ্রিসের উরু পর্যন্ত নাই! চেটে চলেছে শামলি ইদ্রিস কে, তার বড় জিহব্বা দিয়ে৷ জিহব্বায় মনে হয় কিছু আছে৷ কাঁটা কিংবা অমন কিছু৷ যেখানে জিহব্বা লাগছে ছালচামড়া মাংশ সব উঠে আসছে৷ এবার শামলি সুড়ুৎ করে টেনে নিচ্ছে উঠে আসা মাংশ টুকু৷ জিহব্বার ঘসায় হাঁড় পর্যন্ত ক্ষয়ে যাচ্ছে৷ অথচ রক্ত বেরুচ্ছে না এক ফোঁটাও!

দক্ষিণে ইদ্রিসকে তাহলে এই লেইয়া খাউরীই ধরেছিল!

পা ‘টুকু কোন ভাবে তাকে অবশ করে খেয়ে ফেলেছিল৷ লোভ সংবরণ করতে পারেনাই৷ তাই ফিরে এসেছে৷

কি করবে এখন জুলেখা৷ কি করবে৷ এ পিশাচ তো স্বামীকে শেষ করে বাচ্চাদের দিকে হাত বাড়াবে৷ তখন৷ তাকেও আস্ত রাখবে না৷ কি করবে!

মাথায় গিট্টু লেগে গেছে তার ভয়ে আর শংকায়৷ হঠাৎ একটা কথা মনে হল জুলেখার৷

সবচেয়ে ছোট কোলের জেসমিন কে ঘুমন্ত অবস্থায় জোরে চিমটি কাটল৷ এরপর জামাল কে৷ দুটোই চমকে কেঁদে উঠলো৷

শামলি পিশাচটা ঝনঝনে কন্ঠে বলে উঠলো কি “হইল বুবু৷ কান্দে ক্যানে?”

জুলেখা যতটা সম্ভব গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল আরে কইও না একটায় কয় পায়খানায় যাব৷ আরেকটা কয় পেশাব৷ এই দিগদারী ভাল লাগে কও৷

জুলেখা জানে ওর স্বাভাবিক থাকার উপরেই নির্ভর করছে বাচ্চা গুলোর জীবন৷ একটু যদি ওটা বুঝে ফেলে তাহলে এই বেড়া তাদের আটকে রাখতে পারবে না!

শামলি ছিল খাবার লোভে৷ তাই জুলেখার গলা একটু কেঁপে গেলেও বুঝতে পারলো না৷ বলল “ঠিক আছে বুবু যাও করাইয়া লইয়া আস৷” “বাইজানের কাছে আমি তো আছি৷ চিন্তা নাই৷”

জুলেখা আর শামলির কথাবার্তায় ন’বছরের জেরিন উঠে পড়েছে ঘুম থেকে৷ জুলেখা জেরিনের মুখ চেপে ধরে কানে কানে বলল মা’রে একেবারে চুপ৷ যা কইতেছি তা কর৷

ছোট দুটো বাচ্চা কে কোলে নিয়ে পেছন দিকে বেরিয়ে আসলো সে৷ সামনে জেরিন৷ বাইরেটা একেবারেই নিঃস্তব্ধ৷ একটা ব্যাং ও ডাকছে না৷ অথচ এমন অবস্থায় ব্যাং এর ডাকে ঘুমানো যায় না৷

জেরিন কে বলল সে, “মা রে তুই জরী খালার বাড়ির দিকে আগে আগে যা৷ হেগো ডাক দে৷ আমি আসতেছি৷”

দুটো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো জুলেখা৷ সামনে জেরিন৷ ওরা প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছে… বাঁচার তাগিদে৷

জুলেখাকে সবাই বুঝিয়েছে৷ ইদ্রিসকে আর আস্ত পাবার আশা নেই৷ মানে জীবিত পাবার আশা নেই৷ জুলেখা কাঁদছে৷ তার করার কিছুই নেই৷ সবার কথাই ঠিক৷ তাছাড়া এভাবে একটা মানুষের বেঁচে থাকার কি মানে৷ হয়তো লেইয়া খাউরী যতটা খেয়েছে তাতে তার স্বামী আর জীবিত নেই৷ বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে জুলেখা৷জেরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷

চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে৷ এখানকার সকল মানুষ একত্রিত হয়ে জুলেখাদের বাড়ী ঘেরাও করে আছে৷ প্রায় সবার হাতে লাঠি বল্লম রামদাও আর মশাল৷ চারপাশ আলোকিত যাতে ওটা পালাতে না পারে৷

জুলেখাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল সবাই৷ এরপর দাঁড়িয়ে থাকলো৷ পিশাচটার মৃত্যু নিশ্চিৎ না হওয়া পর্যন্ত তারা ওখান থেকে নড়বে না৷

লকলকিয়ে অগ্নি শিখা সব গ্রাস করলো৷ থেকে থেকে ভেতর থেকে ভেসে আসছে তীক্ষ্ম চিৎকার৷ যতবার চিৎকার ভেসে আসছে ততবার জেরিন চমকে চমকে উঠছে৷ সে ভাবছে বাবাকে কেউ বাইরে নিয়ে আসলো না কেন?

……

বিশ বছর পরে৷ আয়ারল্যান্ডের একটা জলাভূমিতে কাজ করতে গেছেন এক পরিবেশবিদ এবং তার টিম৷ সেই টিমে আছে একটা মেয়ে৷ দারুণ কর্মঠ সাহসী আর প্রতিভাবান৷ নাম জেরিন৷ জলাভূমিটায় যেতে আরও ঘন্টা দু’এক লাগবে৷ ওরা একটা সরাইখানায় গাড়ি থামিয়েছে৷ খাবার জন্য৷

ওদের দেখে এবং কোথায় যাচ্ছে জেনে, স্থানীয় বিশাল দেহী এক আইরিশ মাথা নাড়ল৷ ব্যাপারটা চোখ এড়াল না জেরিনের৷ সবাই যখন বের হয়ে গেল, তখন সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো ওখানে কি এমন কিছু আছে যার জন্যে তুমি মাথা নাড়লে৷ তুমি কি মনে কর ওখানে যাওয়া আমাদের উচিৎ নয়৷

আইরিশ লোকটা ফিসফিস করে বলল ইয়াং লেডি, ওখানে, ঐ জলাভূমিতে, ঠিক যে জায়গায় তোমরা যাচ্ছ, সেখানে এমন কিছু একটা আছে যা একা কোন মানুষকে পেলে প্যারালাইজড করে ফেলে৷

চমকে উঠে জেরিন প্রশ্ন করলো তারপর?

আইরিশ চোখ তুলে জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল তারপর লম্বা জিহব্বা দিয়ে স্রেফ চেটে মানুষকে …

জেরিনের মনে হলো এমন একটা ঘটনা সেও কি জানে! ঠিক মনে পড়ছে না…

( লেইয়া= লেহন/চেটে খাওয়া || খাউরী = যে খায় ~নারী অর্থে || পুরুষ বুঝাতে হবে)

-পলাশ পুরকায়স্থ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *