এবার বৃষ্টি বাদল খুব বেশি হচ্ছে। বৃষ্টি নামলেই শশীর কথা খুব মনে পড়ে। শশীর খুব পছন্দ ছিল বর্ষাকাল। বৃষ্টি দেখলেই ভেজার জন্যে উন্মুখ হতো, বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে সে ভিজত। বৃষ্টির সঙ্গে সেকি হুটোপুটি, চঞ্চলতা, যেন ফ্রক পরা ছোট্ট বালিকা, যেন মল ঝমঝম করে হেঁটে যাওয়া কোনো কিশোরী।
এ বাড়িতে এখন আর কেউ মল পায়ে হাঁটে না। শব্দহীন নিথর সময় হেঁটে বেড়ায় একা। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর রাত নেমে আসে, সবাই আসে বড়ো নিঃশব্দে। কেবল বৃষ্টি আসে সশব্দে, ঝমঝমিয়ে কখনো মল, কখনো ঘুঙুর পায়ে। কখনো রাজ্যের পাণ্ডুরতা, বিবর্ণতা নিয়ে।
দেশ থেকে আসার সময় শশী যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল তখন দেখলাম সে যেন কিছু একটা লুকালো। আমি জিজ্জেস করলাম ওটা কী রাখলে? শশী লাজুক হাসিতে বলল, “আমার মল আর ঘুঙুর।”
আমি বললাম কাউকে দিয়ে দিতে।
কাকে দেব, আমার জিনিস দেবইবা কেন?
ওখানে গিয়ে নাচবে? কে দেখবে?
বারে তুমি দেখবে, আর কে?
আমি কি আর সময় পাবো, বিদেশে টেলিকম কোম্পানিগুলো খুব খাটিয়ে মারে।
তাহলে আমার জন্যেই আমি নাচব। তোমাকে দেখতে হবে না। আর এগুলো আমি কাউকে দিচ্ছিও না।
অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর অভিমানে শশী অনেকদিন তার সেই রুপার গহনার বাক্স খোলেনি। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে, রঙিন শাড়ি-চুড়িতে আচ্ছাদিত হয়ে শশী বসে আছে। ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত করেছে লিভিংরুম। মনে হয় কুঞ্জবনে রাধিকা বসে আছে। মন বুঝি খুব প্রসন্ন ছিল সেদিন। আমাকে আফিসের ব্যাগ রাখার সুযোগ না দিয়েই সাউন্ড সিস্টেমে চালু করে দিল রবি বাবুর গান—
গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস-লোকলাজে
সজনি, আও আও লো।
অঙ্গে চারু নীল বাস,
হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস,
কুঞ্জবনমে আও লো॥
ঢালে কুসুম সুরভভার,
ঢালে বিহগ সুরবসার,
ঢালে ইন্দু অমৃতধার
বিমল রজত ভাতি রে।
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে,
অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে,
ফুটল সজনি, পুঞ্জে পুঞ্জে
বকুল যূথি জাতি রে॥
দেখ সজনি, শ্যামরায়
নয়নে প্রেম উথল যায়,
মধুর বদন অমৃতসদন
চন্দ্রমায় নিন্দিছে।
আও আও সজনিবৃন্দ,
হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ
শ্যামকো পদারবিন্দ
ভানুসিংহ বন্দিছে॥
সেদিন ভানুসিংহ না হয়েও আমাকে ভানুসিংহের দ্বায়িত্ব পালন করতে হল। রবীন্দ্রনাথ যখন ভানুসিংহের পদাবলি লেখেন তখন তার বয়স ষোলো। ষোল বছর বয়সি ভানু সিংহ আমার মতো ৩২ বছর বয়সের লোককে ফাসিয়ে দিলেন। ভানুসিংহ দেখল রাধিকা নেচে চলেছে মনের আনন্দে, ভানুসিংহ দেখল কুঞ্জবনমে পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ, হরিণনেত্রে বিমল হাস……
মাঝে মাঝেই শশী এরকম পাগলামো করতো বিশেষত বর্ষায়। আর একবার আমাকে বলল বাড়ি ফেরার সময় কৃষ্ণচূড়ার ফুল নিয়ে আসবে, আজ সন্ধ্যায় আজ আমি ভুমিসুতা সাজবো।
ভুমিসুতা কে?
প্রথম আলোর একটা ক্যারেকটার। তুমি চিনবে না।
কৃষ্ণচূড়ার ফুল কোথায় পাবো?
তার আমি কী জানি!
আমি সন্ধ্যায় যে লাল শাড়িটি পড়ব, সেটির সঙ্গে খোঁপায় কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুঁজতে হবে।
জবা হলে চলবে, ওটাও তো লাল।
না আমার কৃষ্ণচূড়া চাই। জবা একটু কালচে, আমার শাড়ির রঙের সাথে ম্যাচ করবে না।
কিন্তু কৃষ্ণচূড়া পাবোটা কোথায়?
পাবে কোথায় আমি কী করে জানবো? তবে টিপস দিতে পারি, ট্রেন স্টেশনে নেমে হাতের বাঁয়ে যে স্কুলটি পড়ে সে স্কুলের গেটের কাছেই একটা গাছ আছে, আর একটা গাছ আছে আমাদের বাড়ির পাশের জঙ্গলে।
কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটে উঁচু ডালে, ওখানে উঠবো কী করে?
ভুমিসুতাকে পাবার জন্যে ভরত কত কষ্ট স্বীকার করল আর তুমি তো মাত্র কিছু ফুল জোগাড় করবে…
শশী চলে গেছে অনেক দিন হল। হাজারটা কৃষ্ণচুড়ার বাগান দিয়েও তাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ড্রেসিং টেবিলে ছোট্ট একটা ফ্রেমে বাঁধাই করা আছে সেদিনের সেই ভুমিসুতার একটি ছবি। গ্রামের মেয়েদের মতো একপ্যাঁচে শাড়ি পরে খোঁপায় লাল টকটকে ফুল গোঁজা শশী। শশী আজ দূর আকাশের চাঁদ।
শহিদ হোসেন