শিক্ষিত পতিতা (১ম পর্ব)

আমি শিক্ষিত পতিতা। স্বামী সঙ্গের পাশাপাশি আমার অন্য পুরুষের সঙ্গ লাগতো। তবে, সেই সঙ্গের সবগুলোতে শরীর ছিলোনা। দু’একটায় শরীর এসেছে, বাকীগুলোতে আসেনি।

কথাগুলো বলে নির্লিপ্তভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন সুনয়না।
তারপর, ছুঁড়ে দিলেন প্রশ্নবান, কি হে! এটুকু শুনেই কি মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছো?

তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, প্রথম থেকে বলেন। শুরু থেকে শুনতে চাই।

সিগারেটের বাক্স থেকে একটি সিগারেট তুলে নিয়ে তিনি ধরালেন। তারপর বললেন,

আমি এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নিই। ছোটবেলা থেকে আমাকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কোরআন শরীফ পড়া, পর্দা করা, পর পুরুষের সামনে না যাওয়া- সবই মেনে চলতে হতো।
পর পুরুষের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্যে বাবা আমাকে ৫ বছর বয়সে ভর্তি করিয়ে দিলেন মাদ্রাসাতে। তারপর থেকে সম্পূর্ণ ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চলছিলো আমার জীবন।

তারপর, আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি, তখন থেকে জীবনের পরিবর্তন শুরু হলো।

এটুকু বলে চুপ করে গেলেন তিনি। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে উপভোগ করছিলেন আমার কৌতুহলী সত্ত্বাকে।

তার হঠাৎ থেমে যাওয়ায় প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। মেজাজ ঠান্ডা করতে আমিও একটি সিগারেট ধরালাম।

আমার অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে তিনি মৃদু হেসে আবার বলা শুরু করলেন।

একদিন মাদ্রাসা ছুটির পর হুজুর আমাকে থাকতে বললেন। আমি ছুটির পর থেকে গেলাম।
চারদিক নীরব।মাদ্রাসায় হুজুর আর আমি ছাড়া কেউ নেই। তারপর, যা হবার। প্রথমবারের মতো আমি পুরুষের শরীরের স্বাদ পেলাম। যদিও সেটাকে স্বাদ বলার চেয়ে ধর্ষণ বলা উচিৎ। কেননা, আমি তখন মোটেও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার শরীর উপভোগ করার পর হুজুর বলে দিয়েছিলেন, এভাবে যতদিন ডাকবো আসবি, আর কাউকে কিছু বললে তোকে একেবারে মেরে ফেলবো।

ভয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপে কাঁটছিলো আমার সময়গুলি। বাসার কারো সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকায় বলতে পারছিলাম না, পাশাপাশি বাধ্য হয়ে শরীরটাকে ভোগ করতে দিতে হতো। সে এক ভয়াবহ সময়।

পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো কিছুদিন পর। একদিন এরকম ছুটির পর হুজুর রুমে নিয়ে আমার সাথে মিলিত হচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় আরেক হুজুর দেখে ফেলেন।

সবচেয়ে দূর্ভাগ্যের বিষয় তিনি আমার বাবাকে বললে হয়তো আমি কোনভাবে এ অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতাম; কিন্তু, তা হলোনা। তিনিও আমার উপর শারীরিক অত্যাচার শুরু করলেন। এভাবেই নবম শ্রেণীতে থাকতে আমি প্রায় ৫-৬ জন হুজুরের কাছে শরীর বিলিয়ে দিতে বাধ্য।

আমার উপর মানসিক অত্যাচার ঠিক কতটা হয়েছিলো তা বলে বোঝাতে পারবোনা। লম্বা দাঁড়ি আর পাঞ্জাবী দেখলেই আমার ভয় হতো।

এর মধ্যে আমারই এক আত্নীয় এসব জেনে আমাকে ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করে। এবং সেদিনই সর্বনাশ ঘটে আমার। আদৌ কি সর্বনাশ, না মুক্তির পথ খুলে যায়- তা একটু পরে জানবে।

আমি ঋতুময়ী হয়েছি অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে। অন্যরা সবাই প্রতিরোধক ব্যবহার করেছিলো, কিন্তু আত্নীয় তা করেনি। ফলাফল, পেটে সন্তান এসে গেলো।

তারপর, যা হয়। প্রচন্ড মানসিক চাপে ছিলাম। এর মধ্যে বাবা আমার সন্তান নষ্ট করে বিবাহ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, কে করবে এই মেয়েকে বিবাহ।

সম্ভবত ঠিক তখনই স্বয়ং আল্লাহ এসে বাঁচিয়েছেন আমাকে। বাবা হাল ছেড়ে দিয়ে যখন বের করে দিবেন, সমাজ যখন আমাকে তাড়িয়ে দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো, পতিতালয় ছাড়া আর কোন জায়গা আমার জন্য ছিলোনা, ঠিক তখনই হাত বাড়িয়ে দেয় রহিম। আমার বাবাকে সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।

বাবা কোন কিছু না ভেবে সাথে সাথে রহিমের সাথে বিয়ে দিয়ে আমাকে বাসা থেকে বিদায় করে দেন।

এটুকু বলে দম নিলেন সুনয়না। তারপর, আমাকে বললেন, চা খাবে?
আমি বিনাবাক্য ব্যয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালাম খাবো।
তিনি আমার দিকে হেসে বললেন, তাহলে বাকীটা চা খেতে খেতে বলছি।

তারপর, উঠে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
আর আমি বাকশূন্য হয়ে ভাবছি, কত বিচিত্র প্রতিটা মানুষের জীবনটা। অথচ, আমরা সবাই ভাবি আমাদের চেয়ে দুঃখী, আমাদের চেয়ে বেশি কষ্ট কেউ কখনো সয়নি!


অবশেষে পতিতাবৃত্তি পেশায় আমার আগমন ঘটলো। পূর্বের শরীর দেয়া নিতান্তই পরিস্থিতির শিকারের কারণে। কিন্তু, এবার অর্থের বিনিময়ে আমাকে শরীর দিতে হলো।
কথাগুলো বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন সুনয়না।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রহিম আপনাকে বিয়ে করলো। তাহলে, আপনি পতিতাবৃত্তি পেশায় কিভাবে যোগ দিলেন?

তিনি চায়ের কাপে আরেকবার চুমুক দিয়ে বললেন,
রহিমকে বিয়ে করার পর ভেবেছিলাম কলঙ্কের দাগ মুছে নতুন আরেক অধ্যায় শুরু হবে জীবনের।
ঠিকই আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো তবে সেটা আরো বেশি কলঙ্কের।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কিভাবে?
ও আমার দিকে হেসে বললো, রহিম’ই আমাকে পতিতাবৃত্তি পেশায় নামিয়েছিলো।
আমার বিষ্ময় আরো বাড়তে লাগলো। সুনয়না সম্ভবত তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই, আর ভনিতা না করে বলা শুরু করলেন,
রহিম ছিলো ঢাকার এক গরীব রিক্সা চালক। তার টিনের ছোট্ট ঘরে আমি সহ ছিলো আরো দু’জন। রহিম, রহিমের বড় বউ আর আমি। রহিম রিক্সা চালাতো। কিন্তু, তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। রহিমের বড় বউ ঝিঁ এর কাজ করতো, পাশাপাশি সংসার দেখতো।
আর আমি পতিতাবৃত্তি করতাম। রহিম অতিরিক্ত অর্থের আশায় আমাকে বিয়ে করেছিলো আমার শরীরের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের জন্য।
প্রতি রাতে ও খদ্দের নিয়ে আসতো ঘরে। এক রুমে ওরা থাকতো; আর আরেক রুমে খদ্দেরের মনোরঞ্জন করতাম আমি।
আর এর বিনিময়ে পাওয়া অর্থ দিয়ে আমার থাকা-খাওয়া ও রহিমের সংসার চলতো।

এরকম এক অবস্থায় এসে যাওয়ার পর আমার আর বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছাই ছিলোনা। আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্নহত্যার।
তারপর, শেষবারের মতো যেদিন পতিতাবৃত্তির সমাপ্তি ঘটাবো সেদিন সবকিছু বদলে গেলো।

এটুকু বলেই চুপ করে গেলেন সুনয়না।
আমি আমার অস্থিরতা ধরে না রাখতে পেরে বলেই ফেললাম, দয়াকরে থামবেন না। বলতে থাকুন।
মৃদু হেসে তারপর সুনয়না বললেন,

সেদিন আমার কাছে রহিম যে খদ্দের নিয়ে এসেছিলো সে শরীরের জন্য আসেনি। সে এসেছিলো পতিতাদের জীবন কেমন হয়, তারা কেন এ পেশায় আসে- তা জানতে।

তাকে আমি আমার জীবনের সব ঘটনা বললাম। সম্ভবত, ব্যতিক্রম মানুষ পাওয়ায়, পাশাপাশি শেষরাত ভেবে সবকিছু উগড়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো তাই বললাম।

সব শুনে সে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলো, আত্নহত্যা কোন সমাধান নয়। জীবন তো একটাই। মৃত্যুর পর তো কিছু নেই। আর, আপনি ধর্মের বিধান মেনে চলেন, তবে সে অনুসারে জাহান্নামই আপনার একমাত্র জায়গা। ওখানেও তো শান্তি পাবেন না, তাইনা?

তার কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পরছিলাম না। সে ভুল কিছু তো বলেনি।

তারপর, সে আবার বলতে শুরু করলো, জীবন একটি যাত্রা। আপনাকে আপনার গন্তব্যে যেতে হবে। তাইনা?
আপনি হেঁটে যান বা উড়ে যান, যেভাবেই যান না কেনো সে যাত্রায় ময়লা তো লাগবেই। গন্তব্যে পৌঁছে গেলে সে ধুলো মুছে ফেললেই তো হলো।
ধুলো লেগেছে বলে যদি বসে থাকেন, তাহলে কি হবে?
আমি তার কথা শুনে কিছুটা আশা পেলাম। এবং তাকে বললাম, আপনি’ই বলেন আমি কি করবো?
সে আমাকে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো, যেমন চলছে চলতে দিন। ধুলো লাগছে লাগতে দিন। থেমে যাবেন না।
শুধু, সবকিছুর পাশাপাশি পড়ালেখা শুরু করুন। শিক্ষিত হোন। তারপর, যেদিন নিজের ব্যবস্থা নিজের করে ফেলতে পারবেন, সবকিছু ছেড়ে চলে যাবেন। আর একটি কথা সবসময় মনে রাখবেন, অতীতের দিকে ফিরে শিক্ষা নিতে পারেন, কিন্তু অতীতের কথা ভেবে থেমে যাবেন না।

এই বলে, সে সেই রাতের মতো চলে গিয়েছিলো।

কিন্তু, তার কথায় আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেলো। এবং তারপরই বদলে যেতে লাগলো আমার জীবন।

এতটুকু বলে থেমে গেলেন সুনয়না। হয়তো, অতীতে ফিরে গেলেন। তারপর, আমাকে বললেন,
অদ্ভুত, তাই না? জীবনটার জন্য আমরা শরীর পেয়েছি। অথচ, শরীরের জন্য আমার জীবনটাকে বিলিয়ে দিই।

তার কথায় মুগ্ধ হয়ে কি বলবো সেই ভাষাই হারিয়ে ফেলেছি। তারপর, আমার মাথায় আসলো সমরেশের “সাতকাহন” উপন্যাসে পড়া সেই কথাটি, জীবনের জন্য শরীর, শরীরের জন্য জীবন না। এবং তখনই বুঝতে পারলাম, এই মহিলা বাংলা সাহিত্যেরও খোঁজ রাখেন!

– জিসান রাহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *