সার্কাস ( ১ম পর্ব )

‘ঐহানে কেডারে…কির পুত? ফুঁকা দিয়া দেহস কি? রাইতে আহিস, খুইল্যা দেহামুনে’

এমন কথাতেও কলপাড়ের টিনের বেড়ার ওপাশ থেকে লোক দু’জন সড়ে দাঁড়াল না। মুক্তা গলা উঁচিয়ে আরও কিছু নোংরা গালাগাল করল। তাতে মনে হয় লোক দু’জন আরও মজা পেল, হাসির শব্দ শোনা গেল।

মুক্তা দু’জন লোকের উপস্থিতি তোয়াক্কা না করে শরীর থেকে শাড়ি টেনে খুলে ফেলল। ব্লাউজ খুলে পেটিকোট তুলে বুকের উপর বাধঁল। গায়ে কাপড় রেখে সে গোসল করতে পারেনা। মুক্তার দেখাদেখি বাকি দু’জনও কাপড় খুলে ফেলল। এতক্ষণ টিনের বেড়ার ওপাশে থাকা লোক দু’জন নিজেদের মধ্যে কি যেন বলে জোরে জোরে হাসছে। মুক্তার পাশে দাঁড়িয়ে রানি কল চেঁপে বালতিতে পানি ভরছিল। হাসি শুনে সে চেঁচিয়ে উঠল-

‘আইতে চাইলে আয় না! লুকাইয়্যা দেহনের মজা নাই। কাছে আইয়া দেখ, মজা পাবি’

রানির কথায় সোনিয়া হেসে ফেলে গান ধরল-

‘মাটির গাছে লাউ ধইরাছে
লাউ যে বড় সোহাগী, সোহাগী,
আমার লাউয়ের পিছে
লাগছে বৈরাগী’

একটা সুপারহিট গান। এমন একটা গান যে তাদের জন্যই লেখা হয়েছে। সোনিয়ার সাথে রানিও গলা মেলালো।

শরীর নিয়া লাজ শরম করলে তাদের চলে না। যৌবন কালের এই ভরা শরীরের অনেক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতায় পুরুষ সমাজকে ভেঙ্গেচুরে খান খান করা যায়, কোন ব্যাপার না। সপ্তাহে পাচঁদিন সার্কাসের মঞ্চে তারা শরীরের খেলা দেখায়। শত শত দর্শককে মাতিয়ে রাখতে হয় তাদের । শুধু শুধু তো তারা পকেটের টাকা খরচ করে সার্কাস দেখতে আসবে না।

অর্ধ উলঙ্গ তিন কন্যার এমন অশ্লীল কথাবার্তায় হীরা অভ্যস্ত। তবুও শুনতে তার খারাপ লাগে। সেও এদের সাথে গোসল করতে ঢুকেছে। তবে তার জন্য কলপাড়ে একপাশে মোটা প্লাস্টিক ঘিরে আলাদা বন্দবস্ত করা হয়েছে। ভুল বলা হল, তার একার জন্য নয়। তার স্বামী ফয়েজ চৌধুরীর ছয় স্ত্রীর জন্য। সার্কাসের প্রয়োজনে লোকটা বিভিন্ন এলাকা থেকে অসহায় সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করেছেন। এই ছয় সুন্দরী নারী সার্কাসের মধ্যমণি।

সুন্দরের তুলনায় উনিশ বছরের তরুণী হীরার কাছে এরা কিছুই নয়। ফয়েজ চৌধুরীর কাছে তার আলাদা কদর। পার্টির মালিকের কাছে যার এত কদর, অন্যদের কাছে তার সন্মান অনেক বেশি। পার্টির সব লোকই হীরাকে ‘আম্মা ‘ ডাকে। হীরার খুব লজ্জা করে এ জন্য। পার্টির অতি পুরান লোক কলিম চাচা সার্কাসের জোড়া হাতির খেলোয়ার ‘হুত’, বাবার চেয়েও বয়স বেশি লোকটাও যখন তাকে আম্মা ডাকে, হীরা তখন বেশি লজ্জা পায়।

সবার মুখে তার আম্মা’ ডাক ধরিয়ে দেয়া ফয়েজ চৌধুরীর উদ্দেশ্যটা হীরা ভালকরেই জানে। আম্মা’ করে যাকে ডাকা হচ্ছে তাকে অবশ্যই কু’নজরে দেখা যায়না। ‘রওশন সার্কাস পার্টি’তে কু’নজর দেবার লোকের অভাব নাই। তাছাড়া যখন যে এলাকায় পার্টি বসে সে এলাকার মান্য গণ্য লোকদের নজর থাকে সার্কাসের সুন্দরী মেয়েদের উপর। এসব কু’নজর থেকে বাচাঁতে ফয়েজ চৌধুরীর নানা সময় নানা কৌশল করতে হয়।

এতবড় নামকরা একটা সার্কাস পার্টির শত্রুও কম থাকেনা। সেটাও দেখতে হয়। একেক এলাকায় এসে একেক ঝামেলায় পরতে হয়। অনেক চেষ্টা তকবির, থানা পুলিশ সামলিয়ে এই কুঠিবাড়ি এলাকায় তারা এসেছে এক মাসের জন্য। দশ বারো দিনেই ঝামেলা শুরু হয়েছে। এলাকার এক অংশ মানুষ রাত হলেই দলে দলে সার্কাস দেখতে আসছে, আরেক অংশ খেপে উঠেছে সার্কাস পার্টির অস্থায়ী আস্তানা উৎখাত করতে। কিন্তুু ফয়েজ চৌধুরীর মতো এমন ধুরন্ধর লোকের কাছে এসব সামলানো পানিভাত।

কলপাড়ের বেড়ার ওপাশের লোক দু’জনকে ধরা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে খালেক আর কাশেম তাদেরকে তাড়িয়ে ধরেছে। দিনের বেলা এসব তদারকি করার জন্য পার্টিতে লোক আছে। তাদের মধ্যে খালেক, কাশেম, ফয়েজ চৌধুরীর পিয়ারের লোক। এদেরকে হাতে রাখতে হয় নিজের প্রয়োজনেই। ফয়েজ চৌধুরীর এক ইশারায় তারা সব করে।

সারাক্ষণ এরা হীরার সামনে মাথা নিচু করে রাখছে। ‘আম্মা, আম্মা ‘ ডাকছে, এই লোকগুলোই ফয়েজ চৌধুরীর ইশারায় তাকে দড়ি দিয়ে বেধেঁ রেখে সারারাত পাহাড়া দেয়। গরম পানি করে নিয়ে আসে। সেই হালকা গরম পানি ফয়েজ চৌধুরী বেঁধে রাখা হীরার চোখে মুখে ঢালেন নিজ হাতে। কাউকে শাস্তি দেয়ার নতুন নতুন কৌশল তিনি নিজেই ঠিক করেন। শাস্তিটাও নিজ হাতে দেন। শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া চলাকালে অবশ্য ঐ লোকগুলো ধারের কাছে থাকেনা,থাকার অনুমিত নাই। হীরা যখন অজ্ঞান হয়ে যায় তখন তারা ডাক্তার ডেকে আনে। শরীরের কাপড় খুলে উলঙ্গ করে পিটানোর সময় ফয়েজ ঘর বন্ধ করে নেন। জ্ঞান হারাবার পর হীরাকে তিনি নিজ হাতে কাপড় পড়িয়ে মাথায় পানি ঢেলে, ঘায়ে মলম লাগানোর কাজও নিজ হাতে করেন।

দিনের পর দিন হীরাকে এসব শাস্তি সহ্য করতে হচ্ছে,কারণ সে এক চাকার সাইকেলের খেলাটা শিখে উঠতে পারছে না। হীরা দু’বার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তাকে এখন সার্বক্ষণিক কঠিন নজরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন ফয়েজ চৌধুরী।

ভয়ঙ্কর ছোট খাট টাক মাথাওয়ালা মাঝবয়সী এই লোকটা রাতে বিছানায় অন্য মানুষ,কঠিন প্রেমিক। মুখে কিছু বলার আগেই টাকা,গহনা সব পায়ের কাছে হাজির করেন। তাকে শরীরী খেলায় খুশি করতে পারলে জীবনের কোন চাওয়া সে অপূর্ণ রাখে না। হীরা নিজে জানেনা, তার কাছে কত টাকা আছে! তবে এত টাকা তার কোন কাজে লাগেনা। হীরার টাকা চাইনা, এই কুৎসিত ভয়ঙ্কর জীবন থেকে মুক্তি চাই।

চলবে….

-বেলা প্রধান

ছবি কৃতজ্ঞতা – সাখাওয়াত তমাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *