হুলো ( ৪র্থ এবং শেষ পর্ব )

বিকালে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে রাহেলা স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। উৎপাত অনেক হয়েছে, আর নয়। ছেলেমেয়েরা রাতদিন আছে হুলোকে নিয়ে। পড়াশুনাও ঠিকমত করছে না তারা সেটাও তিনি মেনে নিয়েছেন, কিন্তুু আজকের ঘটনা মেনে নেবার মত নয়।

গত রাতে তার ছোট মেয়েটার জন্য এক বাটি দুধ টেবিলে রেখে ফিডার আনতে রান্নাঘরে গেলেন তিনি। এই দুধটুকু সারারাতের জন্য ভরসা। মেয়ে দু’বার ঘুম থেকে জেগে কেদেঁ উঠলেই তাকে মাথার কাছে রাখা দুধের ফিডার মুখে দিতে হয়। ফিডার নিয়ে শোবার ঘরে এসে দেখেন বাটির সেই দুধ সাবার। পায়ের কাছে টেবিলের নিচে হুলো নরম স্বরে মিউ মিউ করছে তখন। যেন খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। রাহেলার রাগে শরীর জ্বলে গেল।

তারপর আবার আজ দুপুরে মেঝো ছেলে রাহীর চিৎকার করে কান্না শুনে ছুটে গেলেন। রাহীর হাতে হুলোর লেজে লাগানো দঁড়ি । হুলোকো টেনে ছেঁচড়ে সে বাহিরে নিতে চেষ্টা করতে দেখে রাজু রাহীর মাথায় চড় দিয়েছে। ব্যস, দু ভাইয়ের মারামারি শুরু। রাহেলা অস্থির হয়ে গেলেন। এক হুলো নিয়ে তার অশান্তির শেষ নাই। তবুও তিনি ছেলেদের বুঝিয়ে ভাজিয়ে সেবেলায় শান্ত হলেন। কিন্তু বিকালে যে ঘটনা ঘটল তিনি তার জন্য মোটেও স্বস্তি আনতে পারছেন না।

তার কোলের মেয়েটাকে হুলো কামড় দিয়ে ঘা করে দিয়েছে। মেয়েকে খেলতে দিয়ে তিনি নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। যাবার সময় মেয়ের কাছে হুলোকে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছেন। মেয়ে দু’হাতে হুলোকে খাঁমচি দিয়ে ধরছে আবার ছেড়ে দিচ্ছে। তিনি ভাবলেন, এই সুযোগে আছড়ের নামাজটা পড়ে আসবেন।

নামাজ দু’রাকাত পড়তেই তিমি মেয়ের কান্না শুনেও নামাজ শেষ করে বারান্দায় এসে হতবাক হয়ে গেলেন। হাতের কাটা জায়গা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। তিনি এক ঝটকায় মেয়েকে কোলে তুলে ছুটে গেলেন ডাক্তারের কাছে। মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পথেই ঠিক করে ফেলেন, আর নয়। রফা দফা আজ একটা করেই ছাড়বেন।

বাসায় ফিরে হুলোকে ধরে তিনি ছোট একটা বস্তায় তুললেন। রাজু মায়ের এমন আচরণে হতভম্ব। সে কাকুতি মিনতি করতে লাগল মাকে। রাহেলা ছেলের অনুরোধ গায়ে মাখলেন না। বস্তাটা নিয়ে বাড়ির বাহিরে গজ পঁচিশেক দূরে মেইন রাস্তার পাশে এসে দাড়ালেন। রাজু মায়ের সাথে ছুটে ছুটে এসে বস্তা ধরে রেখে কেঁদে ফেলল। রাহেলার মন তবুও নরম হলো না। মিনিট দু’য়েকের মধ্যে একটা মাল বোঝাই ট্রাক এসে তাদের সামনে থামল। ট্রাক থেকে একটা লোক নেমে গেল পানের দোকানে। হুলো বস্তার মধ্যে হুটোপুটি করছে যতটা রাজুও ততটাই অস্থির হয়ে হাত পা ছোড়াছুড়ি করে কেদেঁই চলছে। তিনি ছেলের করুন মিনতি উপেক্ষা করে বস্তাটা ট্রাকের উপর ঢিল মারলেন। ট্রাকের লোকটি সিগারেটে টান দিতে দিতে ট্রাকে উঠে যাবার পরই গাড়ি ছেড়ে দিল।

গাড়িটা ছেড়ে দেবার পর রাহেলার মনটা হঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। হঠাৎ হুলোর জন্য মনটা কেমন করল! আহত চোখে দুই মা ছেলে ছেড়ে যাওয়া ট্রাকের দিকে চেয়ে রইল।

ট্রাকটা গজ বিশেক যাবার পরই হুলোর হুটোপুটিতে বস্তটা ধপ করে রাস্তায় পরে গেল। মায়ের হাত ছেড়ে রাজু দৌঁড় দেবার আগেই ট্রাকের পিছনে থাকা বাসটা বস্তাটাকে চাপা দিয়ে পাশ কেটে বেড়িয়ে গেল। ফুলানো পলিথিনের ব্যাগে ভারী চাঁপ পড়লে যেমন শব্দে ফেটে যায়, তেমন একটা শব্দ শোনা গেল সেখান থেকে। রাস্তায় লেপ্টে থাকা বস্তাটা রক্তে ভিজে মাখামাখি মা ছেলের হতবাক চোখের সামনে।

দু’সপ্তাহ কেটে গেল ঘটনার। ডিসেম্বর মাসের কনকনে ঠান্ডা পড়েছে চারদিক। রাহেলা নিজের বিছানায় যাবার আগে ছেলের বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাজু লেপে মুড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। তিনি পাতলা আরেকটা কম্বল খুলে ছেলের গায়ে দিয়ে দিলেন ঠান্ডা কমাতে।

গভীর রাতে আচমকা চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে রাহেলা ছেলের বিছানায় ছুটে গেলেন। ভয়ার্ত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিতে গিয়ে আৎকে উঠলেন। লেপ কম্বল সব ভিজে জবজবে। তিনি ছেলেকে ধমক দিলেন,

‘বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছিস্ কেন?’

রাজু এখনও হাপাঁচ্ছে। শুকনো মুখে থেমে থেমে যা বলল তা হলো-

হুলো আর রাজুকে কে যেন একটা বস্তায় বেঁধে রেখেছে। অন্ধকারে হুলোর চোখ ধকধক করে জ্বলছে। রাজু বুঝতে পেরে যেই হুলো বলে ডেকেছে, ওমনি হুলো রাজুর উপর ঝাঁপিয়ে পরে। হুলোর চার পায়ের নখের আঁচড়ে আর কামড়ে রাজুর শরীর কেটে কেটে রক্ত ঝড়ছে । আর সেই রক্তে বস্তাটা ভিজে লাল হয়ে উঠছে ক্রমেই।

এরপর বাইশ বছর পার হয়েছে। ছেলে মেয়ে সবাই নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। শুধু রাজু আজও একা রাতভর মায়ের আঁচল মুঠি করে ধরে শুয়ে থাকে। রাহেলার বয়স হয়েছে, উপযুক্ত ছেলের শুন্য জীবনে একা হাহাকার করেন। রাজু বলে,

‘মা, আমি ঘুমাতে চাইনা। তুমি আমাকে জাগিয়ে রাখো।’

রাহেলা ছেলেকে শান্তনা দেন, ‘আজ আর হুলো তোকে ধরতে আসবে না। আমি তোর পাশেই জেগে থাকব। হুলো এলে আমি তোকে জাগিয়ে দেব।’

তেত্রিশ বছরের ছেলের ভেজা বিছানার দিকে চেয়ে রাহেলার চোখ ভিজে ওঠে। অদৃষ্টের কথা মনে করে রাহেলা বলে ওঠে, ‘হুলো, এবার আমার ছেলেকে ক্ষমা করে দেয়া যায়না?’

…..

-বেলা প্রধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *